হিয়ার মাঝে পর্ব ১৭
আর্শিয়া ইসলাম হিয়া
সময় টা চার বছর আগে। ক্লাস টুয়েলভ পাস করে গ্রাজুয়েশন আর মাস্টার্স করার জন্য ভ্যাঙ্কুউভারের একটা ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য এপ্লাই করি। বাবা মায়ের কর্মসূত্রে টরেন্টোতে থাকা হতো। কিন্তু ওখানকার থেকে ভাঙ্কুউভারের আবহাওয়া, সৌন্দর্য আমার বেশি পছন্দের ছিলো।
আমার ফুফাতো বোনও সেখানেই থেকে পড়াশোনা করতো। সুযোগ পাওয়ার পর সেখানে চলে যাই। গ্রাজুয়েশনের ২য় বর্ষ চলে তখন, আপু আর আমি যে বাসায় থাকতাম, পাশেই একটা নতুন বাসা তৈরি হচ্ছিলো। সেটা সম্পূর্ণ হতেই একটা পরিবার এসে উঠে। স্বামী, স্ত্রী আর তাদের সন্তান। অবশ্য পরে জানতে পারি মা নামক মানুষটি তার সন্তানটির স্টেপ মাদার।”
আরও পর্ব গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
” সেই সন্তানই আপনার প্রেমিক পুরুষ, তাইনা রায়া?”
রায়া মুচকি হাসলো রাদের প্রশ্নে। এই মুহুর্তে তারা দুজনই রুমের ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আছে। রাদকে অতীতের সবকিছু খুলে বলতে শুরু করেছে সে। এরমাঝেই রাদের প্রশ্ন। রায়া ব্যালকনির গ্রীলে হাত দিয়ে দূর আকাশে দৃষ্টি ফেলে আবার বলতে শুরু করে,
” হ্যাঁ, তার নাম লুইস বয়েলভীন। তার বাবা মা আগেই ডিভোর্স নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন। আগে অন্য সিটিতে ছিলো, পরে ভ্যাঙ্কুউভারে শিফট হয়। আমাদের সাথেই সে মাস্টার্স করতে একই ভার্সিটিতে এডমিশন নেয়। এমনই এক সেপ্টেম্বরের দিন। তার সাথে আমার প্রথম সরাসরি দেখা হয়। পাশাপাশি বাড়ি হলেও আমি সেভাবে লুইসকে দেখিনি। সেদিন পুরো দস্তুরে ভ্যাঙ্কুউভারের বছরের প্রথম বৃষ্টি। ক্লাস শেষে করে বাসায় ফিরেছি সবে।
বৃষ্টি দেখে মন মানলোনা। বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পরলাম। হাটতে হাটতে বাসার পাশেই পার্ক ছিলো একটা। সেখানে চলে গেলাম চিরচারিত নিয়ম ভুলে রেইনকোট বা ছাতা নিয়ে লুইস আসেনি। হাটতে হাটতে হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ একজন পিছন পিছন আসছে৷ পিছ ফিরে তাকালাম। তাকাতেই দেখলাম ধূসর রঙের পাতলা সোয়েটার, কালো জিন্স পরিহিত এক শেতাঙ্গ পুরুষ। তার দিকে তাকাতেই প্রথম দৃষ্টি তার চোখেই ছিলো। ধূসর চোখের মনি, তার গভীরতার ছাপ প্রভাব ফেললো। সেও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকেই। তাকে দেখে কিছু টা তেতেই জিগাসা করেছিলাম, পিছু নিয়েছে কেনো! উত্তরে সে কি বলেছিলো জানেন?”
” কি বলেছিলো?”
রাদ প্রশ্ন করে রায়ার প্রশ্নের বদলে। রায়া ঠোটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বলে,
” আমায় এই বৃষ্টির মাঝে একা বাসা থেকে বেরুতে দেখে সেও এসেছে। যদি কিছু হয়ে যায় আমার! সেদিন আচমকা মনে ভালো লাগা সৃষ্টি হলেও ততটা গুরুত্ব দেইনি। বুঝলাম যে সে অন্য ধর্মের। আমার ভালো লাগার দাম বা তার আমাকে নাও পছন্দ হতে পারে। সেদিন আর কোনো কথা বলিনি। চলে আসি বাসায়। এরপর একসপ্তাহ কেটে যায়, তাকে দেখিনি। কিন্তু তার ধূসর চোখের মনির গভীর চাহনী মনে দাগ কেটেই ছিলো। পুরো ১৩তম দিনের দিন তার সাথে আবার আমার দেখা।
আশ্চর্য জনক ভাবে হলেও পাশাপাশি বাসা হওয়া সত্বেও তাকে আমি দেখতাম না বাসা থেকে বের হলেও। কিন্তু যেদিন দেখা হয়,জানতে পারি সে আপুর ক্লাসমেট। সেই সূত্র ধরে কথাবার্তা আগায়। নাম জানা হয় একে অপরের। সে আমায় রায়া বা বৃষ্টি কোনো নামেই ডাকতে পারতো না। পরে আপু তাকে জানায় আমার নামের ইংলিশ রেইন। সে রেইন ডাকতো আমায়।
অক্টোবরে তার জন্মদিন ছিলো, তার সাথে পরিচয়ের একমাসের মাথাতেই প্রপোজ করে৷ রিজেক্ট করার সাহস হয়নি, সে আমার কিশোরী বয়সে আবেগ ছিলো না।কারণ সেই বয়স কাটিয়ে এসেছি৷ কিন্তু তাকে সব প্রবলেম খুলে বলি। সে ভরসা দেয় সামলে নিবে। কেটে যায় দেড় বছর। তার পরিবার যখন জানতে পারে বাবাকে বাসায় এসে শা’সিয়ে যায়। সেদিন আমার জন্য বাবার চোখের পানি ঝড়েছে।
লুইস এসে বাবার কাছে মাফ চেয়েছে, আমাকে নিজের করে পেতে সুযোগ চেয়েছে। বাবা ধর্ম পাল্টানো আর তার পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে বলেছিলো তার বাবা মা সহ সুন্দর একটা পরিবারে তার মেয়েকে দিবে।আমি দেড় বছরের ভালোবাসার জন্য বাবার ২৩বছরের ভালোবাসা ছেড়ে যেতে পারিনি, কিন্তু তাকে পেতে সবরকমই সাহায্য করেছি।
সে নিজের চেষ্টায় বাবা মাকে এক করে, ধর্ম পাল্টানোর সময়ও আসে। কে’টে যায় দুবছর। মাস্টার্সে উঠলাম,১ম সেমিস্টার দিলাম। লুইস বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তার বাবা মা সহ, সব শর্ত মেনে। আমার বাবা তাকেই দেশ থেকে ঘুরে যাওয়ার বাহানায় এসে দেখেন আপনার সাথে জড়িয়ে দিলো। সে কিন্তু আমায় জড়িয়ে ধরেছে, গালে কিস করেছে। আপনার বউকে একটু হলেও পরপুরুষ ছুয়েছে। ঘৃণা লাগবেনা আমায়?”
রাদ মনোযোগ দিয়ে রায়ার কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সে রায়ার দু বাহুতে হাত রেখে নিজের দিকে ফিরায়। রাস্তার নিয়নবাতির ঝাপসা আলোয় নিজের বউকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে রাদ। রায়াকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে। রায়া আচমকা এমন হওয়ায় খানিক টা চমকায়। কিন্তু সে রাদ কে ছাড়ায় না, না জড়িয়ে ধরে। কিন্তু রাদ রায়ার মাথা নিজের বুকের উপর শক্ত করে ধরে বলে,
” এই যে হৃৎস্পন্দন! সবটুকুই রায়ার নামে স্পন্দন করে। উপরওয়ালা আমায় হালাল একটা সম্পর্কের মাধ্যমে একজন মানুষ আমায় দিয়েছেন। তাকে ভালোবেসে,সম্মানের সহিত আগলে রাখার দায়িত্ব আমার। অতীত কমবেশি অনেকেরই থাকে। তাই বলে ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে রাখার মানেই হয় না। তোমাকে বড্ড ভালোবাসি বউ।”
রায়া চোখ বন্ধ করে আছে। দু’ফোটা চোখের জল গড়িয়ে পরে তার। রাদ বুকে গরম পানির অনুভব করলেও কিছু বলে না। কেঁদে নিক, মন হালকা হবে। রাদ যত্নের সাথে রায়াকে আগলে ধরে রাখে।
পরেরদিন সকালবেলায়,
ড্র-ইং রুমে সোফায় বসে আছে ইহসাস। গালে হাত দিয়ে চিন্তা করছে সে, কি করে রাদদের সঙ্গে যাওয়া যায়। গতকাল রাত্রে ভাইকে বুঝানোর পরও তার ভাই বুঝেনি তাকে নিয়ে যেতে রাজী হয়নি৷ হিয়ার প্রতি তার দুর্বলতা রাদ মানতে নারাজ। না মানার অবশ্য কিছু কারণ আছে৷ ইহসাসের মনে যখন এসব আকাশ কুসুম চিন্তা, তখুনি হাই-হিল পড়া একজন মেয়ে তাদের দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে।
ইহসাস ফ্লোরের দিকে মাথা দিয়ে থাকায় চেহারা দেখতে পাচ্ছে না। এমন উচু জুতার অধিকারী কে! এটা দেখতে সে মাথা উচিতে তাকায়। তাকাতেই থমকে যা। রাতে যে আপদ কে নিয়ে রাদ তাকে বুঝালো, সেই আপদ সকাল হতেই হাজীর! শে’ষ। এবার তার রাদদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার যাও একটা সুযোগ ছিলো সেটাও শেষ। ইহসাস যখন মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছে আর বারবার ফাঁকা ঢোক গিলছে, তখুনি মেয়েটা সোজা ইহসাসের চোখের সামনে চুটকি বাজিয়ে জিগাসা করে,
” কেমন আছো, ইহসাস?”
” হ্যাঁ! ”
ইহসাস ঝাকি দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকায়। আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝে কখন যে মেয়েটা এসে তার সামনে দাড়িয়েছে, টেরও পায়নি সে। মেয়ে টা হাস্যজ্ব’ল মুখে ফের প্রশ্ন করে,
” আরে তুমি এরকম চমকে উঠলে কেনো?”
‘শা’কচু’ন্নি দেখলে যে কেউই চমকাবে। ইহসাস মাথা চুলকাতে চুলকাতে আনমনে বিরবির করে। মেয়েটি ইহসাসের কথা বুঝতে না পেরে জিগাসা করে,
” কিছু বললে? ”
” না। না, কি বলবো আমি? কেমন আছো? এতো সকাল সকাল আসলে যে!”
” এমনিই সবাইকে খুব মিস করছিলাম, তাই চলে আসলাম। স্পেশালি তোমায় একটু বেশিই মিস করছিলাম।”
ইহসাসের শুকনো কাশি উঠে যায় মেয়েটির কথায়। মেয়েটি ইহসাসের দিকে এগিয়ে এসে পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলে,
” আরে কি হলো!”
ইহসাস কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিজে নিজে আবার বিরবির করে বলে, ‘সিরিয়ালের নায়িকাদের হার মানাবে এই নটাঙ্কিবা’জ। এসেই ড্রামা শুরু। কি দেখে আমার মা এরে এতো ভালোবাসে! গড সেভ মি।’ ইহসাস যখন একা একাই বিরবির করছিলো, তখন মেয়েটা জিগাসা করে বসে,
” পরিবারের বাকিরা কোথায়?”
! মা,বড়মা,আনিকা ভাবী,নতুন ভাবী কিচেনে। নাতাশা ঘুমায়।বাবা, বড় বাবা বাজারে, রাদ ভাই তার শালীকে আনতে গেছে। আমি বেচারা তোমার ঝা’মেলায় ফে’সে আছি আপাতত।”
ইহসাস একদমে তাড়াতাড়ি করে কথাটা বলে। ইহসাসের এমন উত্তরে মেয়েটা হকচকিয়ে যায়৷ সে ঝা’মেলা! কি বুঝাতে চাইলো ইহসাস! সে ইহসাসকে প্রশ্ন করে,
” আমি ঝা’মেলা মানে কি ইহসাস? ”
ঠিক তখনই রাদ আর হিয়া বাসায় প্রবেশ করে। রাদের হাতে লাগেজ আর হিয়ার হাতেও হ্যান্ডব্যাগ। হিয়া ড্রইং রুমে পা দিয়ে ইহসাসের কাছে একটা মেয়েকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়। এ মেয়েটা আবার কে! প্রশ্নটা আবার মনে উঁকি দেয়। রাদ তো ইহসাসের এই অবস্থা দেখে মনে মনে বলেই ফেলে, ‘ ইহসাস রে, তুই গেলি। সম্পর্ক শুরু না হতেই সুনা’মাী হাজির।’
ইহসাস দরজার দিকে তাকিয়ে হিয়া আর রাদকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মনে মনে ভেবে উঠে,
” শে’ ষ, সব শেষ। ইহসাস আর বাঁইচা নাই, এই মহিলারে দেখে এর ব্যপারে জেনে হিয়া না উল্টাপাল্টা ভাবে!’ ইহসাস উপর দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে আনমনে ভেবে উঠে, ‘ আল্লাহ বাঁচাও।’
হিয়ার মাঝে পর্ব ১৬
মেয়েটা তো ইহসাসের মুখের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে ইহসাসের এমন প্রতিক্রিয়ার মানে টা কি! তার বুঝে আসছেনা।
হিয়া রাদ আর ইহসাসের এমন ভীত মুখ দেখে প্রশ্ন করে,
” মেয়েটি কে দুলাভাই?”