হিয়ার মাঝে পর্ব ১১
আর্শিয়া ইসলাম হিয়া
” লুইস ব্রো সু’ইসা’ইডের চেষ্টা করেছে। উনার মম-ড্যাড আপু আর আমাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলো, কাউকে পায়নি। ভাইয়ার কাছে গিয়েছিলো খোজ জানাতে। কিন্তু ভাইয়া উ’গ্র ব্যবহার করায় উনারা ভাইয়াকে শাস্তি স্বরুপ উনাদের লোক দিয়ে মে”রেছে। ভাইয়ার মাথায় আঘাত পেয়েছে গুরুতর। এখনও সেন্স আসেনি। আর লুইস ব্রো তারও অবস্থা খারাপ। তার বাবা মা রে’গে আছে। লুইস ব্রো ঠিক না হলে তাদের সন্তানের ক্ষ’তি করার দায়ে ভাইয়ারও ক্ষ’তি করে ফেলবে৷ ”
হিয়ার উত্তরে তার বাবা-মা কি বলবে ভাষা খুজে পাচ্ছে না। তারা এখানে মেয়ের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত, অথচ ছেলের জীবন-ম’রণের প্রশ্ন উঠেছে। আর উনারা ছেলের খোজ নেওয়ার চেষ্টাই করেননি। মিঃ শাহীন হিয়া প্রশ্ন করলেন,
” কবে হয়েছে এসব?”
” এটা সঠিক জানিনা বাবা। আপুর বিয়ের জন্য ফোন কি! এটাই ভুলে গিয়েছিলাম। ”
আরও পর্ব গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
হিয়া ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়। মিসেস অন্তরা মেয়েকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেন৷ মিঃ শাহীন কি বলবে, কি করবে বুঝতে পারছেন না৷ মেয়ের ভালো করতে গিয়ে ছেলের জীবন সংকটের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিয়েছেন৷ আচ্ছা রায়ার বিয়ে দিয়ে উনি কি ভুল করলেন! এক পরিবার তাদের সন্তানকে হারাতে বসেছে, বিনিময়ে নিজেও তো সন্তান হারানোর পথে। রায়ার কান্না মাখা মুখটা ভেসে উঠে মিঃ শাহীনের চোখে। তিনি পারছেন না শুধু কাঁদতে। মিসেস অন্তরাকে সামলাতে ব্যস্ত হিয়া। এরমাঝেই মিঃ শাহীন বলে উঠলেন,
” অন্তরা সব প্যাক করো। আমরা কানাডা ফিরছি। আমি টিকিট বুক করে দিচ্ছি।”
মিসেস অন্তরা চোখ মুছে উঠে দাড়ালেন। নিজের রুমে গিয়ে সব গুছানোর জন্য তোড়জোড় শুরু করলেন। মিঃ শাহীন হিয়ার রুমে বসেই অনলাইন এ টিকেট বুকিং করে নিলেন। হিয়াও বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ায়। ওয়ার্ডড্রব খুলে নিজের প্রয়োজনীয় কাপড় বের করে রুমে থাকা সিঙ্গেল সোফায় ঢিবি দেয়। তা দেখে মিঃ শাহীন বলেন,
” তুমি এগুলো বের করছো কেনো হিয়া?”
হিয়া বাবার কথা মানে বুঝতে পারে না। সে বাবাকে উত্তর দেয়,
” কেনো বাবা? আমি কি তোমাদের সাথে ফিরবো না? ”
” না। ”
হিয়া অবাক হয়। সে ফিরবে না, মানে টা কি? সে বাবাকে ফের প্রশ্ন করে,
” মানে? কেনো ফিরবো না আমি?”
” রায়াকে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না আম্মু। তুমি তোমার আপুর কাছে থেকে যাবে৷ ”
“না আব্বু, আমি যাবো।”
” জিদ কেনো করছো হিয়া?”
” ইউ নো আব্বু তোমরা দুজনই ফিরে গিয়ে আম্মু তার জব আর তুমি তোমার জব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরবে। আমার ভাইয়ের কেয়ার করার জন্য তোমাদের সময় হবে না।”
” হিয়া? ”
মিঃ শাহীন চি’ৎকার করে উঠেন হিয়ার উপর। হিয়া তাচ্ছিল্য ভরা হাসি ফেরত দেয় বাবার চিৎ’কারে। এরপর বলে,
” ভুল বলেছি কি আব্বু? সেই ছোট্ট থেকে বড় হয়েছি, কখনও ফুফুর কাছে, কখনও বা বাসার মেইডদের কাছে। তোমাদের সাথে তো সেই উইকেন্ড ছাড়া দেখাই হতো না। সকালে আমরা ঘুম থেকে উঠতে লেট করতাম, নয়তো দেখা যেতো রাতে তোমাদের অপেক্ষায় ঘুমিয়ে পরতাম। জীবনটা একটা একঘেয়েমিতে তিক্ত হয়ে উঠেছিলো। তোমরা যে বাঙালি, তোমাদের সংস্কৃতি এক রকম, সেটা ভুলেই গিয়েছিলে।
সারাক্ষণ কাজ, কাজ আর কাজ। আর মাস শেষে স্কুলে প্যারেন্টস টিচার মিটিং এ কোনো অবজেকশন পেলেই শুরু হতো তোমাদের বাবা মায়ের শাসন। জীবন টা ঘুম, স্কুল, পড়াশোনায় ভালো গ্রেডিং পয়েন্ট আর রাতের ঘুম এটুকুতেই বেধে দিয়েছিলে। রবিবারে একটু সময় চাইলে সবসময় বলতে সারা সপ্তাহ ছুটোছুটি করেছো এখন একটু রেস্ট দরকার তোমাদের। ছোটো থাকতে তবু সময় দিতে, বড় হতেই তোমাদের যে দরকার আমাদের ভাই বোনদের ভুলেই গিয়েছিলে।
ভাইয়া এজন্যই তোমাদের কথা শুনে চলে না, বড় আপুও অন্য ধর্মের একটা ছেলেকে ভালোবেসে ফেললো। ছেলেটা তার পরিবার সহ ধর্ম পাল্টে আপুকে চাইলো, দিলেনা। বিয়ের সময় তোমাদের নিজেদের বাবা মায়ের দায়িত্বের কথা মনে পরলো। সেই জন্যই বলি তোমাদের কাজ ছেড়ে দেশে আসলে কেনো!
বড় আপু আর ভাইয়া একটু আকটু সময় দিতো আমায়। তাদেরও দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছো? মানসিক ভাবে টিনএজ এ একটা স্রোত বয়ে চলে ছেলে-মেয়েদের জীবনে। সেটা ভাবোইনি তোমরা। আমার মা একজন সাইক্রিয়াটিস্ট, উনি সবার ট্রিটমেন্টের জন্য ধৈর্য ধরে কথা শুনেন। শুধু ছেলে মেয়েদের নয়।
তুমি তো তুমি, তোমার তুলনা হয় না। ছেলে-মেয়ে কে ভয় ছাড়া কিছু দাও না৷ এই যে দেখো দেশে এসে মাম্মা, তুমি কত সুন্দর সময় দিচ্ছো, মাম্মা সংসার সামলাচ্ছে। আমি সবসময় এমন পরিবার আশা করেছি। কিন্তু তোমরা শুধু টাকার পেছনেই ছুটে গেলে। এখন মেয়ের জীবন ন’ষ্ট করেছো, ছেলেটাও ম’রতে বসেছে। নাউ তুমি হ্যাপি তো বাবা? ”
মিঃ শাহীন মেয়ের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। হিয়া যা বলেছে ভুল বলেনি। ছেলে মেয়েগুলো বড় হওয়ার পরপরই উনি ধরে নিয়েছিলেন, তারা আত্মনির্ভরশীল হয়েছে, তারা তাদের জীবনে কারোর হস্তক্ষেপ হয়তো পছন্দ করবে না। ছেলে টাও বেপরোয়া স্বভাবের। কখনও কোনো কথা শুনতো না।
ভেবেছিলেন মেয়েরাও হয়তো সেরকমই হবে। কিন্তু উনি ভুলে বসেছিলেন, বিদেশের মাটিতে মেয়েদের জন্ম হলেও বাঙালি সংস্কৃতিতে মানুষ করা হয়েছে তাদের। তারা তো বাঙালি সন্তানদের মতোই মা বাবার কাছে আশা রাখবেই। মিঃ শাহীন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। হিয়ার কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখলেন। হিয়া ওয়ার্ডড্রবের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে কাঁদছে। মেয়েটা কাঁদে না সহজে। যা হয় নিজে নিজেই সামলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এতোদিনের চাপা অভিমান উগরে দিয়ে আজ কাঁদছে। মিঃ শাহীন বুঝতে পারেন মেয়েকে কতটা একাকিত্মের মানসিক অশান্তিতে ভুগিয়েছেন। তিনি হিয়ার চোখের পানি মুছিয়ে বলেন,
” তুমিও যাবে আমাদের সাথে? ”
” হুম ফিরবো। ”
হিয়া নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে উত্তর দেয়। মিঃ শাহীন হিয়াকে বললেন,
” কিন্তু আম্মু, তোমার বড় আপুর কথাও একটু ভাবো। তাকে একা ফেলে সবাই যাবো! ওয়াদা করলাম তোমাকে তোমার ভাইয়ের অযত্ন করবো না৷ তুমি প্লিজ আমার কথাটা রাখো। আর অন্তরকে সুস্থ করে আমরা একেবারে চলে আসবো দেশে। প্রমিজ করলাম তোমায়। ”
” না বাবা, ঐদেশ টা আমার জন্মভূমি। নিজের মাতৃভূমিকে যতটা ভালোবাসি, জন্মভূমিকেও ততটাই ভালোবাসি। এইদেশে একেবারে থাকতে চাইনা। বছরে বছরে এসে ঘুরে যাবো এটাই ভালো আমার জন্য। এই দেশে থেকে আপুর মতো তিক্ত যন্ত্র”ণার মুখোমুখি হতে চাইনা। ”
শেষের দিকের কথা হিয়া আস্তেই বললো, যেনো বাবা শুনতে না পায়। এরপর চোখ বন্ধ করে নেয়। ইহসাসের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। সে কি এ কয়দিনেই ইহসাসের উপর দুর্বল হয়ে গেলো! ঝট করে চোখ খুলে নেয় হিয়া। না এসব নিয়ে সে ভাবতে চায় না৷ মিঃ শাহেদ মেয়ের কথার জবাবে বলেন,
” আচ্ছা যেটা ভালো বুঝো। কাপড় গুলো উঠিয়ে রাখো। অল্প কিছু গুছিয়ে নাও। ”
” কেনো? ”
” রায়ার কাছে রেখে যাবো তোমায়। ”
” না বাবা, বোনের শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে থাকতে আমি রাজী নই।”
” কেনো? ”
” নতুন আত্মীয়, তাদের বাসায় গিয়ে থাকা, ব্যাপারট কেমন একটা না। আমি মামাদের কাছে থাকবো। আপুকে ২-১দিন পরপর গিয়ে দেখে আসবো। ”
” আচ্ছা, আমি গিয়ে দেখি তোমার আম্মুর গোছগাছ কতদূর! আগামীকাল দুপুরের পরপর বেরিয়ে পরবো। রাতের ফ্লাইট। সকালে গিয়ে রায়াকে বলে আসবো, আর সাথে দেখেও আসবো। আর হ্যাঁ একটা কথা আম্মু! ”
” কি কথা? ”
” তোমার রাদ ভাইয়া মানুষ টা খারাপ নয়। এতো ভুলের মাঝেও একটা ঠিক কাজ করেছি। তোমার আপু ভালো থাকবে দেখবে। রাদ ছেলে টা বড্ড সহজ সরল আর ভালো। ”
” সহজ সরল পেয়েই আপুর অতীত লুকিয়ে ঠকিয়ে দিলে বাবা। তুমি জানো না তোমার বড় মেয়ে তার অতীত নিয়ে নিজে সাফার করার সাথে সাথে ঐ ভালো মানুষ টাকেও কষ্ট দিচ্ছে।”
মিঃ শাহীন মেয়ের কথায় দীর্ঘশ্বাস ব্যতিত কিছু বলতে পারেন না৷ মেয়ে যা বলছে ভুল কিছু বলেনি। তিনি রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পা বাড়ান। কিন্তু দরজার সামনে মিসেস অন্তরাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখেন। মিসেস অন্তরার চোখের জল ঝড়ছে৷ আচ্ছা আজ কি কান্না দিবস! মেয়েও কাঁদে, তার মা-ও কাঁদে। মিঃ শাহীন স্ত্রীকে পাশ কা’টিয়ে চলে যান। যেতে যেতে চোখের কোণে জমা জল বুড়ো আঙুল দিয়ে মুছে ফেলেন।
পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই! আচ্ছা তারা কি পাথর, যে তাদের কষ্ট বলতে কিছু থাকেনা! যার জন্য সবাই বলে পুরুষদের কাঁদতে নেই৷ মিসেস অন্তরা স্বামী চলে যেতেই মেয়ের কাছে যান। হিয়া অনুভূতি শূণ্য, সে দাড়িয়ে আছে পাথরের মতো। মিসেস অন্তরা মেয়েকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
” তোর বাবা আর তোর সব কথাই আমি শুনেছি। তোর বাবাকে ডাকতে এসে কথাগুলো শুনে ফেলেছি। আমাদের মাফ করে দিস আম্মু। ”
” মাফ চাইছো কেনো মাম্মা! তোমরা তোমাদের দায়িত্ব পালন করে গেছো। আমাদের কোনো কিছু বলার নাই। যাও সব গোছগাছ করে নাও।”
হিয়া মায়ের কথায় ছন্নছাড়া ভাবে উত্তর দেয়। মিসেস অন্তরা হিয়াকে প্রশ্ন করেন,
” আচ্ছা হিয়া! রায়ার বিয়েটা দিয়ে সত্যিই ভুল করে ফেললাম?
”
” কিছু বলার নাই আম্মু বিয়ের বিষয়ে। শুধু বলবো, সুন্দর সাজানো গোছানো জীবন এলেমেলো হয়ে গেলো। রোজ তোমার বড় মেয়ে অন্তরদ”হনে পু’ড়বে। ”
হিয়ার মাঝে পর্ব ১০
মায়ের কথায় উত্তর দিয়ে হিয়া মা-কে ছাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়৷ মিসেস অন্তরা সেখানেই দাড়িয়ে থাকেন। ভাবেন, এই দ’হনে তার মেয়ে বাঁচতে পারবে তো! হিয়া ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়। ওয়াশরুমের আয়নায় তাকিয়ে আনমনে ভাবে,
” এইদেশে থেকে আপুর মতো রোজ রোজ ভেতরে ভেতরে শে’ষ হতে পারবোনা। কিছুদিন পর আমিও চলে যাবো। ”