হিয়ার মাঝে পর্ব ১
আর্শিয়া ইসলাম হিয়া
” আমার বিয়ের সময় তো শ্বাশুড়ি মা মুখে চিনি দিয়ে ঘরে তুলেছিলো। তোমার ভাগ্য দেখো একেবারে সোনার বালা হাতে পরিয়ে ঘরে তুললো তোমায়। এরপরও মন খারাপ তোমার! ”
বউ সাজে ফুলে সজ্জিত খাটে বসে আছে রায়া। তার পাশেই বসে আছে তার বোন হিয়া। রায়ার চোখের পানি বাধ মানছেনা যেনো। তার জন্য খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকেই রায়ার উদ্দেশ্যে কথাটুকু বলে রায়ার জা আনিকা। তার কথার উত্তরে হিয়া বলে উঠে,
” আমার বোনকে কি আপনার লোভী মনে হয়? ”
” ওমা লোভী মনে হবে কেনো? ”
” এই সোনার বালা দিয়ে নামানোর কথা বললেন যে? ”
” বললাম এই জন্য, সে কাদছে। যদি আমার কথা শুনে একটু রাগারাগি করে কান্নাটা থামায়। ”
মুচকি হেসে হিয়ার কথার উত্তর দেয় আনিকা। খাবার টা বেড সাইড টেবিলে রেখে হিয়াকে বলে,
আরও পর্ব গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
” বোনকে খাইয়ে দিতে পারবে? না পারলে বলো আমি খাইয়ে দিয়ে যাই! মেয়েটা কাঁদছে, তুলে খাওয়ার অবস্থা ওর নেইব।”
হিয়া একপলক আনিকাকে দেখে ভাতের প্লেটের দিকে তাকায়। তরকারির বাটিতে ওর বোনের প্রিয় খাবার গরুর গোস্তের ঝোল আলু দিয়ে। হিয়া পাশে রাখা গ্লাসে পানি ঢেলে বাটিতে হাত ধুয়ে ভাতের প্লেট হাতে নেয়। ভাতের লোকমা বানিয়ে বোনের মুখের সামনে ধরে। রায়া এতোক্ষণ কাঁদলেও ভাত মুখের সামনে ধরায় কান্না থামিয়ে কাঠ গলায় উত্তর দেয়,
” খাবো না আমি। আপনি ভাত নিয়ে যান। ”
আনিকাকে কথাটা বলে রায়া। আনিকা রুমে রাখা সিঙ্গেল সোফায় বসে ওদের দুবোনকে দেখছিলো। সারা বাড়িতে মানুষে মানুষে গিজগিজ করছে। সবার সামনে দিয়ে ভাতের প্লেট নিয়ে এসেছে। না খাইয়ে ভাত সহ প্লেট নিয়ে যাবেনা। আনিকা উঠে এসে হাত ধুয়ে প্লেট নেয়।
রায়ার অন্য পাশে বসে ভাতের লোকমা বানিয়ে ফের রায়ার সামনে ধরে। রায়া ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে ছিলো। আনিকা মুখের সামনে ভাত ধরতেই চোখ তুলে তাকায় সে। অসহায় চোখে তাকায় আনিকার দিকে। আনিকা চোখের ইশারায় বুঝায় ভাত মুখে নিতে। নতুন মানুষ, আদর করে খাইয়ে দিতে চাচ্ছে। রায়া অসম্মান করে কিভাবে! সে ভাতটুকু নিশব্দে গিলে নেয়। হিয়া একটু হাসলো রায়ার প্রতি আনিকার স্নেহ মাখা ব্যবহার দেখে। আনিকা খাওয়াতে খাওয়াতেই রায়াকে বলে,
” কান্নাকাটি দেখেই বুঝেছি বিয়েতে মত ছিলো না হয়তো তোমার। না জেনেই কথাটা বললাম, আমি কি ভুল বলেছি রায়া? ”
রায়া মাথা নাড়িয়ে না বুঝায়। আনিকা আরেক লোকমা ভাত মাখিয়ে রায়ার মুখে দিতে দিতে বলে,
” ভাগ্যের উপর কিছু হয়না বোন। এখন হয়তো কাঁদছো বিয়েটা হয়েছে বলে। একদিন কাঁদবে আমার দেবরকে পেয়েছো বলে। কথাটা মিলিয়ে নিও। আর হ্যাঁ আমি তোমার বড় বোন বুঝেছো। জা ভেবে শ’ত্রু বানিও না যেনো। ”
রায়া মুচকি হাসে আনিকার কথায়। হিয়া আনিকারে ফের এক নজর দেখে। মানুষ টাকে যতটা বা’জে ভাবলো প্রথমে ততটা বাজে সে নয়। হিয়া উঠে দাড়ায়। ভারী লেহেঙ্গা দুহাতে উচু করে ধরে বলে,
” আপু আমি ফ্রেশ হতাম। আমাকে যদি একটা রুম দেখিয়ে দেওয়া হতো! ”
” দু মিনিট একটু বসো, আমি প্লেট রেখে হাত টা ধুয়ে আসি। ”
আনিকা রায়াকে খাওয়া শেষ করিয়ে বাইরে চলে যায় প্লেট নিয়ে। হিয়া ফ্লোরে বসে পরে বোনের হাটুর উপর দুহাত রেখে রায়ার মুখের দিকে তাকায়। রায়া চোখ বন্ধ করে আবার চোখের জল ফেলতে শুরু করছে। হিয়া বোনকে বলে উঠে,
” এখনও কাঁদবি আপু? ভাগ্য ছিলো, হয়ে গেছে। প্লিজ একটু নরমাল হওয়ার চেষ্টা কর। ”
” আমার বোধহয় তাকে আর চোখের দেখাও দেখা হবে না রে হিয়া। সে জানবেও না তার রেইনের বিয়ে হয়ে গেছে। সে ফিরবেনা আর সেই সাদা তুষারের দেশে। রেইন হয়ে ঝড়বেনা তার কাছে। ”
” বাবা যে এমন করবে তোর সাথে দেশে এনে। যদি একটু জানতাম বিশ্বাস কর ভুলেও মুখে আনতাম না, দেশে আসার কথা। ”
” হিয়া চলো, ফ্রেশ হবে বললে যে? ”
আনিকা দরজায় দাড়িয়ে হিয়াকে ডাকতেই হিয়া লেহেঙ্গা ধরে উঠে দাড়ায়। রুমের এককোণায় রাখা লাগেজ থেকে নিজের জন্য ড্রেস বের করে রায়াকে একনজর দেখে চলে যায় আনিকার সাথে। যাওয়ার সময় আনিকা বলে যায়,
” তুমিও ফ্রেশ হও রায়া। আমার দেবর কখন ঘরে আসে ঠিক নেই। বউ সাজে অপেক্ষা করার দরকার নেই।
ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় হিয়া। মাত্র সাতটা দিনের মাঝে তার বোনের জীবন টা কেমন এলেমেলো হয়ে গেলো। ভাবতেই হিয়ার কান্না পাচ্ছে খুব করে৷ সাতদিন আগে বাংলাদেশের মাটিতে পা দিয়েছিলো হিয়ার পরিবার। বড় হওয়ার পর প্রথম দেশে আসা। অনেকটা খুশি ছিলো সে। মা বাবা তিনভাই বোনকে নিয়ে তার পরিবার৷ সবাই কানাডাতেই সেটেল্ড। দেশে আসেনা সেভাবে, হিয়া জিদ করে এসেছে তার নানা নানিকে দেখার কথা বলে।
বড় হওয়ার পর তাদের আদর সে পায়নি। যখন পাওয়ার জন্য আসলো, আসতেই দুদিন পর তার বাবা বলে রায়ার বিয়ে তার বন্ধুর ছেলের সাথে। এরপর পাঁচদিনের মাথায় আজ বিয়েটা হয়েই গেলো। হিয়া অনেক চেষ্টা করেছে তার বাবাকে বুঝানোর তার বোন যে অন্য কাউকে ভালোবাসে৷ কিন্তু তার বাবা বুঝেনি, কিছু সমস্যার কারণে সম্পর্কটা মেনে নিলেন না উনি। বিয়ের পর নতুন বউয়ের সাথে নাকি দাদী-নানী আসে। রায়ার দাদী নেই। সেজন্য হিয়াকেই তার মা, মামীরা মিলে পাঠিয়ে দিলো। বোনের মানসিক অবস্থা কেমন হবে ভেবে সেও আসতে রাজী হয়।
আসার পর গাড়ি থেকে বউ নামানো, বউয়ের মুখ দেখা কত কি এরপর রায়া মানুষের মাঝেই কান্না করে দেয়। সবাই পরিবার ছেড়ে এসেছে, কষ্ট হচ্ছে ভেবে রায়ার নতুন ঠিকানা,নতুন রুম, তার স্বামীর রুমে তাকে সহ বসিয়ে যায়। এরপর তো আনিকা এসে খাইয়ে যায়। কিন্তু হিয়া ছাড়া কেউ জানেও না তার বোন ঠিক কি কারণে কাঁদছে। বোনের মনের মধ্যে কি ঝ’ ড় যাচ্ছে অনুভব করতে না পারলেও আন্দাজ করতে পারে হিয়া৷ চোখ বন্ধ করে বিরবির করে বলে,
” এমনটা না করলেও পারতে বাবা। ”
ঘড়িতে এখন বাজে রাতের দেড়টা। হিয়া চলে যাওয়ার পর রায়া বিছানার এককোণে গুটিশুটি মে”রে শুয়ে পরে। ফ্রেশ হওয়ার মতো এনার্জি তার নেই। ভারী লেহেঙ্গা পরেই সে ঘুমিয়ে পরেছে। কান্নার দমকে মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গিয়েছে তার৷ শরীরে কারোর মৃদুমন্দ ধাক্কা অনুভব করতেই ঘুম টা ভেঙে যায় রায়ার। তার ঘুম খুব পাতলা। হালকা শব্দেই বা ধা”ক্কায় তার ঘুম ফিকে হয়ে যায়। এমনিই কাঁচা ঘুম,সেজন্য সহজেই ভেঙে যায়।
সে চোখ পিটপিট করে তাকায়। চোখের সামনে পুরুষ মানুষের চেহারা দেখে সে চিৎকার দিতে মুখ খুলতেই তার সামনে অবস্থান রত মানুষ টা হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে তার৷ রায়া এবার চোখের পলক ফেলা যেনো ভুলে গেছে। এবার সেই মানুষ টা তার ভরাট কন্ঠে বলে উঠে,
” আমাকে দেখতে কি মানুষের থেকে অন্য রকম। এভাবে চিৎকার করে উঠছেন কেনো? ”
রায়ার মুখ থেকে সে মানুষটা হাত সরিয়ে। রায়া নিজেকে ধাতস্থ করে। নিজের দিকে নজর বুলিয়ে বুঝতে পারে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, সে অন্য কারোর বউ, আর যার বউ সে সামনে উপস্থিত। ক্ষণিকের জন্য ঘুমিয়ে সে নিজের বিয়ের কথাই ভুলতে বসেছিলো। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার কেঁদে ফেলে। তার স্বামী নামক মানুষটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে দাড়ায় ফ্রেশ হতে। লাগেজ থেকে কাপড় বের করার সময় শুনতে পায়,
” কোনো মেয়েকে বিয়েতে এতো কাঁদতে দেখিনি, যতটা আপনাকে দেখলাম। এই বিয়েতে কি আপনার মতামত ছিলো না? ”
” সেটা বিয়ের আগে জানার চেষ্টা করা উচিত ছিলো। ”
রুঢ় কন্ঠে উত্তরটা দিয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় রায়া। রায়ার স্বামী রায়া খাটের যে পাশে শুয়েছিলো সেখানে হতভম্বের মতো দাড়িয়ে রইলো। রায়ার উত্তরে তার মনে চিন্তার উদয় হলো, সে কোনো মেয়ের জীবন নষ্ট করলো না তো!
পরেরদিন সকালবেলায়,
আনিকার ডাকে ঘুম ভাঙে হিয়ার। আনিকা ডেকে চলে গেছে। হিয়া দেয়ালে ঝুলানো ঘড়িতে সময় দেখে সকাল দশটা বেজে গেছে। এতোবেলা অব্দি ঘুমালো সে। তার বোন কোথায়! কি অবস্থায় ভেবেই তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই একজন পুরুষকে ঘরের ভিতর তার শার্ট খুলতে দেখে চিৎকার করে উঠে। হিয়ার চিৎকারে সে মানুষটি পিছ ফিরে তাকায়৷ হিয়াকে দেখে শার্টের বোতাম আবার লাগিয়ে ফেলে। হিয়া তাকে দেখে রে”গে বলে,
” কারোর রুমে ঢুকতে হলে পারমিশন লাগে জানেন না? দুমদাম রুমে এসে সোজা ড্রেস চেঞ্জ করতে ধরেছেন? ”
” তার আগে বলুন আপনি কে? আমার রুমে দাড়িয়ে আমাকেই বলেন পারমিশনের কথা, আর আমি কে? ”
হিয়া ছেলেটার উত্তরে ভেবাচেকা খেয়ে যায়। আনিকা ভাবী তাকে এটা কার রুমে দিয়ে গেলো। রুমের চারদিকে নজর বুলিয়ে দেয়ালে ছেলেটার ছবি দেখে বুঝতে পারে রুমটা উনারই।
এটা সিওর হয়ে হিয়া আনিকা ভাবী বলে দেয় একটা চিৎকার। সে থামার আগেই ছেলেটার দ্রুত গতিতে এসে হিয়ার মুখ ছেপে সোজা ওয়াশরুমের দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকায় এহেন কান্ডে। এতো দ্রুত এটা কি হয়ে গেলো! সে চোখ দিয়ে ইশারা করে ছেলেটাকে হাত সরাতে৷ তার আগে ছেলেটা চোখ রাঙিয়ে বলে,
” রুমের দরজা লক করা আছে। এভাবে আপনাকে আমার সাথে আমার রুমে দেখলে মানুষ কি বলবে ভেবেছেন? বিয়ে বাড়ি মানুষের অভাব নেই। না বুঝেই চিৎকার দিয়ে ফেললেন৷ ”