অবেলায় এলে তুমি শেষ পর্ব
তামান্না ইসলাম কথা
সকাল নয়টা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। সকালের মিষ্টি রোদ চলে গিয়ে এখন সমস্ত আকাশ জুড়ে কালো মেঘের আনাগোনা ছুটে চলেছে। দূর থেকে বজ্রপাতের শব্দ শুনা যাচ্ছে সে-ই সাথে আকাশে বিদ্যুৎ খেলছে। হঠাৎ করেই নিকটবর্তী স্থানে হয়তো বজ্রপাত হয় যার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় কিন্তু চোখ না খুলেই কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ অবস্থায় রইলাম। কিন্তু একটু পরই মুখের উপর কারো নিঃশ্বাস পড়তেই চোখ মেলে দেখি নিহান আমার নিকট এসে ঝুকে আছে। কোনো দূরত্ব নেই। নিহানেয নাকের সাথে নিজের নাকের ছুঁয়ে যাচ্ছে। ঘুম জড়ানো চোখে নিহানকে এভাবে কাছে দেখে আমার নিজের নিঃশ্বাস থেমে যাচ্ছে বারংবার।
” মেয়ে তুমি কি জানো ঘুমন্ত অবস্থায় তোমাকে কতটা নিষ্পাপ লাগে? তুমি কি জানো মেয়ে, তোমার ঘুমন্ত চেহারা দেখতে দেখতে আমার রাত কেটে যায়? তোমার ঘুমন্ত মুখাবয়ব আমাকে কাছে টানে। আমি বারংবার তোমার ঘুমন্ত আঁখিতে আমার ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে যায়। আচ্ছা তোমার ঘুমন্ত মুখাবয়ব আমাকে কেনো এতো উতলা করে তুলে?”
আমার এলোমেলো চুল গুলো বারবার কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে আদুরে গলায় কথা গুলো বললো নিহান।
” আপনি কি সারারাত না ঘুমিয়ে এইসব করে বেড়ান মিস্টার নিহান? পাহারাদারদের মতো কি পা….”
“আহঃ!”
আরও গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
” কি হয়েছে আপনার? কোথায় ব্যাথা পেলেন দেখি। আমার দিকে তাকান।”
আমার কথা শেষ করার আগেই নিহানের আর্তনাদ শুনে উঠে বসে উক্ত কথা গুলো নিহানের সমস্ত মুখাবয়ব হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলাম।
” কিছু হয়নি। এমনি একটু তোমাকে ব্যতিব্যস্ত করতে নাটক ক,,,,”
” একদম আমাকে মিথ্যে কথা বলার চেষ্টা করবেন না। ব্যাথা পেয়েছেন সেটা আমার থেকে কেনো লুকাতে চাচ্ছেন? আমাকে ভালো করে দেখতে দিন।”
নিহানকে কথার মাঝে থামিয়ে দিয়ে কথা গুলো বলে আবারও দেখতে শুরু করলাম। একসময় পেয়েও গেলাম। মস্তিষ্কে চাপ দিতেই গতরাতের ঘটনাগুলো মনে পড়তে শুরু করলো। সে-ই অন্ধকার রুমে অরিত্রি, আয়ান ছিল।
” নিহার আমি সবটা শুনতে চাই। অরিত্রি তো মারা গিয়েছিল তাহলে অরিত্রি বেঁচে আছে কি ভাবে? আয়ান সে-ই বা এখানে কি ভাবে এলো? নিহান আমাকে সব কিছু বলবেন আর সত্যিটা বলবেন।”
চোখ মুখ কঠিন করে নিহানের মুখমুখি হয়ে কথাটা বললে নিহানের দিকে তাকিয়ে রইলাম সব কিছু শুনবো বলে।
” হ্যাঁ অরিত্রি বেঁচে ছিলো কিন্তু এখন আর বেঁচে নেই। আমিও তোমার মতোই জানতাম অরিত্রি মারা গেছে। কিন্তু আমি কিছু বিষয়ে রিচার্স করতে গিয়ে জানতে পারি অরিত্রি মারা যায়নি আর এইসব কিছু অরিত্রি প্ল্যান করে করেছে। আর আয়ান অরিত্রির বোনকে মেরে ফেলে কিছু কারণে যেটা আমার জানা নেই কিন্তু আয়ান তার সম্পূর্ণ দায় আমাকে দেয় এবং অরিত্রিকে এইটা বলে প্রভাবিত করে যে, আমি অরিত্রির বোনকে মেরে ফেলেছি। যার ফলস্বরূপ অরিত্রি আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে নিজের মিথ্যে মারা যাওয়ার নাটক তৈরি করে।”
“আয়ানের এইসব করে আখের লাভ কি ছিল? সে তো আপনার বন্ধু ছিলো। বন্ধু হয়ে আরেক বন্ধুকে এভাবে কেনো ফাঁদে ফেললো?”
” হ্যাঁ! আয়ান আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল এখনো আছে। জানো আয়ানকে আমি সব সময় নিজের ভাইয়ের মতো ভেবে এসেছি। আমি আর আয়ান দুইজনেই ছিলাম লেখাপড়ায় মেধাবী। শুধু লেখাপড়া না বলতে গেলে সব কিছুতেই আমাদের জুড়ি মেলা ভার ছিল। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক সবার কাছেই আমরা প্রিয় ছিলাম। দুইজনে দুজনের সব কিছু শেয়ার করতাম। কিন্তু আমি সবাইকে নিজের কথা দিয়ে মায়ায় ফেলতে পারতাম আর এইটা আমার মা বলেছিল।
আর এমনটা হাওয়ার জন্য সবার কাছে আয়ানের থেকে একটু বেশি প্রাধান্য পেয়ে গেলাম। আন্টি আংকেল মানে আয়ানের মা বাবাও আমাকে পছন্দ করতেন আর আয়ানকে বলতেন যেনো আমার মতো হয়। এই ভাবে যাচ্ছিল সব কিছু। সব কিছু ঠিক ভাবে চলছিল হুট করেই একদিন অরিত্রি আসে। ধীরে ধীরে পরিচয় হয়, বন্ধুত্ব হয় আর এই বন্ধুত্ব থেকে ত্রিমাত্রিক প্রণয় ঘটে। আমি কখনো জানতে পারিনি আয়ান অরিত্রিকে ভালোবাসে। যদি জানতে পারতাম তাহলে আমি আয়ানের জন্য আমি অরিত্রিকে সেক্রিফাইস করে দিতাম।
কিন্তু আমি কখনো বুঝতে পারিনি আয়ানের মনের কথা। আমি না বুঝতে পারিনি যে, আমি নিজের অজান্তেই নিজের কাছের বন্ধুকে নিজের শত্রু বানিয়ে নিয়েছি। প্রতিহিংসা থেকে আয়ান অরিত্রিকে নিজের ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে আমারই গোপনে। কিন্তু আয়ান উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ চলে যায় কয়েক বছরের জন্য কিন্তু ভার্সিটি অফ পেলেই মাঝে মাঝে দেশে আসতো। তখনো অরিত্রি এবং আয়ান গোপনে ভালোবেসে যাচ্ছিল। হুট করেই একদিন অরিত্রিকে আমি বিয়ে করে নিয়ে আসি বাড়িতে।
মা অরিত্রির বিষয়ে জানতো তাই সহজেই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের বিয়ের পর থেকে আয়ান অরিত্রি থেকে এবং আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে উঠেপড়ে লাগে। আর এতো কিছু করে।”
কথা গুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো নিহান। এরই মাঝে বাহিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। ঝুম বৃষ্টি। থেমে থেমে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আগের থেকে বেশি। আর ঘনঘন বজ্রপাত হচ্ছে কাছেপিঠে।
” তোমাকে আরেকটা কথা বলার ছিলো তরী।”
এতো সময় অন্যদিকে ফিরে কথা গুলো বলছিল নিহান। কিন্তু এবার আমার দিকে ফিরে কথাটা বললো। আমি কোনো উত্তর না দিয়ে আগের মতো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
“আমার আর অরিত্রির বিয়ে হয়নি। অরিত্রি এবং আয়ান সম্পর্কে থাকাকালীন ফিজিক্যাল হয় এবং অরিত্রি প্রেগন্যান্ট হয়ে। আমি যখন সত্যিটা জানার পরেও আমি তখন অরিত্রিকে বিয়ে করতে চাই আর কিছুর জন্য না হলেও বাচ্চাটার জন্য বলি।
কিন্তু অরিত্রি আয়ানের প্রেমে এতোটাই পাগল ছিল যে, বিয়ে করতে না করে দেয়। কিন্তু অরিত্রির তখন কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না বলেই মিথ্যে কথা বলে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। এক ছাদের নীচে থাকতে শুরু করি কিন্তু আলাদা আলাদা ভাবে। আমি সোফায় আর অরিত্রি বিছানায় ঘুমাতো। তরী আমি এই সত্যিটা লুকিয়ে রেখে এসেছি তার একটাই কারণ, নিরাত্রি। নিরাত্রি আমার মেয়ে। আমি চাই সম্পূর্ণ দুনিয়া নিরাত্রিকে আমার মেয়ে হিসেবে চেনোক।”
” নিরাত্রি আমার মেয়ে নিহান। নিরাত্রি আপনার আর আমার মেয়ে। আমি নিরাত্রিকে সব সময় আমার কাছে রাখতে চাই নিহান। সম্পূর্ণ পৃথিবী যেমন করে জানবে নিরাত্রির বাবা আপনি ঠিক তেমন ভাবেই পৃথিবী জানবে নিরাত্রির মা আমি। নিরাত্রি আমাদের সন্তান।”
নিহানকে কথা গুলো বলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। মানুষটা কখনো নিজের ভিতরে জমে থাকা কথা গুলো মুখ ফুটে বলে না। সব কিছু নিজের ভিতর জমিয়ে রাখে। আজকে কথা গুলো বলে কতটা রিল্যাক্স ফিল করছে তা নিহানের হার্টবিট এবং নিঃশ্বাস বলে দিচ্ছে। এই মানুষটা ভালোবাসার বিপরীতে কষ্ট পেয়ে এসেছে। আমি আর কখনোই কষ্ট পেতে দিবো না। নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসবো।
সময় যে কারো জন্য থেমে থাকে না সে নিজের আপন গতিতে ছুটে চলে। কেটে গেছে ছয়টি বছর। এই চার বছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। শুধু পরিবর্তন হয়নি ” সুখবিন্দর নিবাস” বাড়ির মানুষ গুলোর ভালোবাসা। নিহান সে-ই আগের মতোই আছে। আমার মেয়ে নিরাত্রি না হয়ে যাচ্ছে। আমার এখনো মনে পড়ে এই তো কিছুদিন আগে আমার শাশুড়ি আম্মা বাসর ঘরে নিরাত্রিকে নিয়ে রুমে আসলো। কিন্তু না এমন কিছুই না! সময় কেটে গেছে ছয়টি বছর। নিরাত্রি এখন স্কুলে যায়, নিজের ছোট্ট ভাই কাব্যর সাথে খেলা করে। শাশুড়ি আম্মারও বয়স হয়ে গেছে। পুরানো সব কিছু মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঐশীর হাতে কফি দিয়ে চললাম ছাদের দিকে। বাহিরে মেঘ ডাকছে সাথে প্রবল বাতাস। মনে হচ্ছে ঝড় বৃষ্টি হবে। অনেক দিন হলো বৃষ্টি ভেজা হয় না। আজকে এই সুযোগে ভিজতে পারবো।
ছাদে পা দিতে না দিতেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। মূহুর্তের মাঝেই ভিজে একাকার হয়ে গেলাম। এতো দিন পর বৃষ্টিতে ভিজতে পেরে কোনো দিক না তাকিয়ে ইচ্ছে মতো ভিজতে লাগলাম।
” তুমি বৃষ্টির মতো স্নিগ্ধ, তুমি মায়াবতী। হঠাৎ তোমার গর্জে উঠা আমার ভীষণ প্রিয়। প্রিয় তোমার চোখের ভাষা, তোমার ভালোবাসা, তোমার বোকার মতো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। তুমি যে আমার ভালোবাসা।”
হুট করেই কানের কাছে কথা গুলো বলতেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। এই কন্ঠের স্বর যে আমার চেনা। খুব চেনা। এই কন্ঠের মালিকের সব কিছু আমার চেনা। আশেপাশে থাকলেই মানুষটার শরীরের গন্ধ ভেসে এসে জানান দেয় মানুষটা আমার কাছেই আছে।
অবেলায় এলে তুমি পর্ব ২৮(২)
“তুমি আমার অবেলায় বেড়ে উঠা ভালোবাসা, তুমি আমার অবেলায় কাছে আসা একমুঠো সুখ। তুমি আমার অবেলায় প্রেম বন্দনার দুঃখ। #তুমি_এলে_অবেলায় আমার জীবনে নিয়ে আসা একফালি বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যার পর নেমে আসা রোদ। তুমি আমার অপ্রাপ্তির খাতায় হঠাৎ ভালোবাসার বড় এক প্রাপ্তির নাম।”