অবেলায় এলে তুমি - bhuapurnews24

অবেলায় এলে তুমি পর্ব ৮

অবেলায় এলে তুমি

অবেলায় এলে তুমি পর্ব ৮
তামান্না ইসলাম কথা

নিস্তব্ধ রজনী, গোমট পরিবেশ। বাহিরের দমকা হাওয়ায় বারবার জানালার পর্দা উড়িয়ে দিচ্ছে। আকাশে মেঘেরা পাল্লা দিয়ে ছেঁটে চলেছে।‌ মাঝে মাঝে মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে চাঁদ। তবুও নিজের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে সে। রাতের শেষ প্রহর চলছে। রুমে থাকা তিন জন ব্যক্তির মাঝে দুইজনেই ঘুমের সাগরে তলিয়ে আছে।

ঘুম নেয় শুধু তৃতীয় ব্যক্তির চোখে। নিহান একবার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকা দু’জন ব্যক্তিকে দেখে বিছানা থেকে নেমে গেলো। নিজ পাশ থেকে নেমে এসে একবার তরীর কাছে এসে কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চুল গুলো ঠিক করে দিলো। আজ প্রথম যেনো নিহান তরীকে ভালো করে দেখলো। সেই একই জায়গায় তিল রয়েছে। ঠিক ডান ব্রুয়ের মাঝ বরাবর একটা তিল অরিত্রির ছিলো। কারণে অকারণে নিহান সেখানে ছুঁয়ে দিতো।

আরও গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন  

অরিত্রির কথা ভাবতে ভাবতে নিহান তরীর দিকে ঝুকে পড়তেই ঘুমের ঘোরে নিহানের গালে একটা চড় পড়ে যায়। উল্টো থেকে সোজা হতেই নিহানের গালে চড় পড়ে। চড় খেয়ে নিহান কিছু সময় বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।
“এই মেয়ের ঘুমের মধ্যেও হাত তুলতে ভুলে না। জেগে থাকলে মুখ চলে আর ঘুমের মধ্যে হাত চলে।। আল্লাহ তুমি আমার কাছে এই কি মেয়ে পাঠালে? এই মেয়ে তো আমাকে জেগে থেকেও জ্বালিয়ে মারে আবার ঘুমন্ত অবস্থায় মারে।”
কথা গুলো বলে বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে চাবি নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

একটা বন্ধ রুমের ভিতর হাত, মুখ বাঁধা অবস্থায় বসে আছে পঞ্চাশ বছর বয়সী লোক। আশেপাশে আরো দুইজন একই অবস্থায় অচেতন হয়ে আছে। তাদের শরীরের দাগ গুলো বলে দিচ্ছে কেউ তাদের ইচ্ছে মতো মেরেছে। যেখানে যেখানে মা’র পড়েছে সেখানে কালসিটে পড়ে আছে। লোকটা একবার তাদের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢুক গিলে নিলো। তৃষ্ণায় গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। চারিদিক থেকে কেমন পঁচা গন্ধ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে কোথাও ইঁদুর মরে পড়ে আছে। লোকটা অচেতন হওয়া লোকদের দেখে নিজের হাতের বাঁধন ছোটাতে লাগল। কিন্তু পারলো না। উল্টো হাত ঘষাঘষি করার জন্য কিছু অংশে ছিলে গিয়ে জ্বালা করতে লাগলো। তবুও লোকটা চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো।

” ডাক্তার সেন এতো নড়াচড়া করবেন না। শরীরের এনার্জি ফুরিয়ে যাবে যে।”
রুমে প্রবেশ করতে করতে কথা গুলো বললো নিহান। নিহানকে দেখে ড.সেন যেনো অবাকের শেষ স্তরে পৌঁছে গেলো। যতটা অবাক হয়েছে নিহানকে দেখে তার থেকে বেশি ভয় পাচ্ছে তার হাতের হকি স্টিক দেখে। নিজের ভয়কে প্রকাশ না করে শুধু নিহানের দিকে তাকিয়ে রইল।

“অবাক হচ্ছেন কেনো আপনি? এতো অবাক হয়ে যাওয়ার কিছু তো এখনো হয়নি।”
কথা গুলো বলতে বলতে লোকটার সামনে এসে বসে মুখের বাঁধন খুলে দিয়ে কথা গুলো বললো।
“তুমি? তুমি আমাকে এখানে কেনো এভাবে বেঁধে রেখেছো? আর এই দুইজনই বা কে?”
মুখের বাঁধন আলগা হতেই হাঁপাতে হাঁপাতে নিহানকে কথা গুলো বললেন ড.সেন।
“এতো অস্থির হয়ে যাচ্ছেন কেনো আপনি? মাত্র তো এলাম। আমাকে দেখেই এতোটা অস্থির হয়ে গেলে চলবে? এখনো তো অনেক কিছুই বাকি আছে।”

“বাকি আছে মানে?”
“এইসব মানেটানে ছাড়ুন। আমার কাছে এতো সময় নেই।”
“তোমার কাছে সময় নেই তাহলে আমাকে কেনো এখনো এখানে বেঁধে রেখেছো? যেতে দাও আমাকে।”
লোকটি কথা বলার সাথে সাথে লোকটির পায়ে সজোরে একটা বারি মারে নিহান। হকি স্ট্রিকের বারি খেয়ে লোকটি সাথে সাথে চিৎকার দিয়ে উঠলো।

“যেতে দিবো? কত গুলো মাস তোর ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলাম জানিস?”
“তুমি আমাকে তুই-তুকারি করছো কেনো?”
কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে হাতের মধ্যে আরেকটা বারি পড়লো। লোকটার চিৎকার অচেতন হয়ে পড়ে থাকা লোক গুলোও পিট পিট করে তাকিয়ে দেখে ঢুক গিলতে লাগলো। তাদের যে কত বড় ভুল হয়েছিল এই ডাক্তারের কথা শুনে। এখন মনে হচ্ছে নিজের জীবন নিয়ে ফেরাও মুশকিল।

“তোকে এখনো জীবিত অবস্থায় রেখেছি সেটাই অনেক ভালো। ভুলে গেলি আমি কোথা থেকে এসেছি? তুই কি ভেবেছিলি আমার অরিত্রিকে মেরে , দেশ পালিয়ে বেঁচে থাকতে পারবি? আগে পালের গোদা বের করি তারপর একে একে সব কটাকে বেঁচে থাকার আত্মচিৎকার শুনবো।”

কথা গুলো বলে আবারও কিছুক্ষণ লোকটাকে হকি স্ট্রিক দিয়ে বারি মেরে রুমকে তালাবদ্ধ করে চলে গেলো নিহান। লোকটাকে বেধড়ক মারধর করতে দেখে বাকি দুজন সেখানে আবারো আগের মতো চুপ করে গুটিসুটি মেরে রইলো। তাদের আর বুঝতে বাকি নেই যে নিহান তাদেরকেও মেরে ফেলবে। বাহিরে সেই মানুষ আর এখানে নিহান। কারো না কারো হাতে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত।

সকাল সকাল নিরাত্রিকে নিয়ে বসে আছি। এমনি এমনি বসে রইনি বরং হাতে খাবারের বাটি নিয়ে বসে আছি । নিরাত্রিকে এখন বাড়তি খাবার খাওয়ানো শুরু করেছি। মেয়েটা খেতে চাই না। খাবার মুখে দিলেই সেটা ফেলে দিচ্ছে। হয়তো মুখে নিয়ে হিহি করে হেসে ফেলে দিচ্ছে নয়তো জিহ্বা দিয়ে ঠিলে ফেলে দিচ্ছি। এই দিকে নিরাত্রিকে খাওয়াতে গিয়ে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। মেয়েকে দেখো মুখে খাবার দিতে গেলেই হাত নাড়িয়ে ফেলে দিচ্ছে।

“এই মেয়ে তুই কি খাবি? খাবার দিচ্ছি চুপচাপ খেয়ে নিবি। তোর বাবা বলে তোর দেখভালের জন্য লোক নিয়ে আসবে। আমি কি তোর কেয়ার করতে পারি না? তোর বাবা শুধু আছে আমার ভুল ধরতে। সব কিছুতেই আমার ভুল ধরা চাই। শোন, তুই তো আমার লক্ষী মেয়ে তাই না! যখন তোর বাবা তোর দেখভালের জন্য লোক নিয়ে আসবে তখন বেশি বেশি কান্না করবি। যেনো সেই ব্যক্তি বিরক্ত হয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। আমার তো তোকে কারো কাছে দিতে ইচ্ছে করে না। এই তো সোনা খাবার প্রায় শেষ, এবার আমরা নানু বাড়ি যাবো।”

নিরাত্রিকে খাওয়াতে খাওয়াতে কথা গুলো বললাম। কিন্তু মেয়ে দেখো কিছু বুঝতে পারুক আর না পারুক মুখ ভরে হাসতে পারে। মেয়েটা যে কবে বড় হবে আর গুটি গুটি পায়ে সমস্ত বাড়ি ঘুরে ফিরবে।
” এখনই মেয়েকে কান পড়া শেখানো হচ্ছে? বড় হলে তো মেয়ে আমার মা’কে ছাড়া কোনো কথাই বলবে না।”
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা গুলো বললো নিহান। আমার সব কথা যে শুনেছে তাঁতে ভুল নেই। শুনলে শুনবে! তাতে আমার কি?

“মেয়ে আমার। সে আমার কথা শুনবে এইটাই স্বাভাবিক। মেয়ে আমার আর কারো কথা শুনতে যাবে কেনো?”
নিরাত্রিকে মুখ মুছে দিয়ে কথা গুলো বললাম।
“বললেই হলো না কি? নিরাত্রি আমারও মেয়ে। আর একটা কথা জানো তুমি যে, মেয়েরা বাবার ভক্ত হয়? তাই মেয়ে সব সময় আমার কথা শুনবে, তোমার কথা নয়।”

কথা গুলো বলতে বলতে আমার সামনে এসে দাড়ালো নিহান। আমি একবার লোকটার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিলাম। এতো লম্বা হতে কে বলেছে লোকটাকে? একটু দেখতে গেলেই হা করে তাকিয়ে থাকতে হয়।
“মেয়ে আমার কথা শুনবে এবং আমার মতোই হবে। এইটা শেষ কথা। আর একটা কথাও না বলে গোসল করে রেডি হয়ে আসুন। মামা ফোন করেছিল। আমরা কখন যাবো সেই কথা জানতে। এখন আপনি রেডি হয়ে আসুন। আর হ্যাঁ ভুলেও নিরাত্রিকে দেখভালের জন্য এই বাড়িতে কাউকে নিয়ে আসবেন না। নয়তো আমরা মা মেয়ে নানু বাড়ি চলে যাবো।”

কথা গুলো বলে খাটের উপর থেকে নিরাত্রির জামাকাপড় সহ আমরা মা মেয়ে বের হয়ে শাশুড়ি আম্মার রুমে চলে গেলাম।

একটা কালো রঙের শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি গুলো ঠিক করছি। দুই হাতে শাড়ির সাথে ম্যাচ করে কালো চুড়ি পড়েছি। চুল গুলো খোঁপা করে ছাদ থেকে কিছু বেলিফুল নিয়ে গেঁথে খোঁপাই পড়েছি। তরতাজা ফুলের সুবাস ছড়াচ্ছে রুম জুড়ে। শাড়িটা ভদ্রলোক গতকাল নিয়ে এসেছে বাড়ি ফেরার পথে। কিন্তু সেটা আমাকে না দিয়ে শাশুড়ি আম্মার রুমে দিয়ে এসেছিল আমাকে দিয়ে দেওয়ার জন্য। হুঁ! নিজে শাড়ি নিয়ে এলে মানসম্মান চলে যেতো মনে হয়।

“এখনো কি আপনি রেডি হতে পারেননি? আর কতক্ষণ লাগবে? সবাইতো…”
কথা গুলো শেষ করার আগেই চুপ করে গেলো নিহান। ঝুঁকি দিয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করাই শাড়ির আঁচলের অংশ সরে যাওয়ায় ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় পেটে কিছু অংশ স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। ভদ্রলোকের এমন সময় উপস্থিতি আমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিলো। নিজেকে কোনো রকম সামলে নিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি লোকটা এখনো সেখানে দাঁড়িয়ে আছে হাঁ করে।

“আমার হয়ে গিয়েছে, আপনি নিচে যান আমি এখনই আসছি।”
ভদ্রলোককে কথাটা বলে সেখানে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে লাগলাম। ভদ্রলোক নিজেও সাদা শার্ট পড়েছে। দেখতে সুন্দর লাগছে অনেক। ভদ্রলোক নিজেকে এমন করে ফিট রাখে যাকে দেখলে বোঝা দায় হয়ে পড়ে যে, ভদ্রলোক এক কন্যা সন্তানের বাপ।
“শুনো চোখে কাজল দিও না। এতো সাজতে হবে না। শাড়িটা ঠিক মতো ক্যারি করিও। নিচে সবাই অপেক্ষায় আছি। তাড়াতাড়ি চলে আসো।”

কথাটা বলেই ভদ্রলোক যে ভাবে এসেছিল ঠিক সেই ভাবে রুম থেকে চলে গেলো। আর আমি শুধু হাঁ করে তার আসা যাওয়া দেখতে লাগলাম।

অবেলায় এলে তুমি পর্ব ৭

” তরী তোকে না শাড়িতে পুরাই হট লাগছে।”
কথাটা কানে শ্রবণ হতেই পাশ ফিরে গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে থাপ্পড় দিলাম লোকটাকে।

অবেলায় এলে তুমি পর্ব ৯