অবেলায় এলে তুমি পর্ব ২৮(২)
তামান্না ইসলাম কথা
যেই মানুষটিকে একটা সময় ভালোবাসতো, চোখের মাঝে ছিলো ভালোবাসা, সম্পূর্ণ মুখে ছিল মায়ার চাদরে ঘেরা আজকে সেই চোখে ঘৃণা ছাড়া আর কিছু দেখতে পারছে না নিহান। চোখ মুখ করে তুলেছে হিংস্র। অরিত্রি যেনো নিজের নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে কোনো কথা শুনতে রাজি না। কিন্তু এই ভুল থেকে যে কোনো কিছু হয়ে যেতে পারে।
” তোমার বাবা নিজেই মারা গিয়েছে সেই দায় তুমি আমাকে কেনো দিচ্ছো?”
” শুধু মাত্র তোমার আমার বাবাকে মৃত্যু বেছে নিতে হয়েছে। তবুও বলছো তোমাকে দায়ী করবো না? আমার বাবার কি দোষ ছিলো? তোমার থেকে বড় পজিশন নেওয়া? নাকি তোমার এই অপকর্ম জেনে গিয়েছিল এইটা?”
” তোমার বাবার কোনো ভালো মানুষ ছিলো না। বরং রাতের অন্ধকারে তোমার বাবা মেয়ে পাচার করতো। শুধু মেয়ে পাচার না বরং তোমার বাবা মেয়েদের চাকরি দেওয়ার নাম করে নিজের গেস্ট হাউসে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করতো এবং দিনের আলো ফোটার আগেই তাদের লাশ গুম করে দিতো।”
আরও গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
“চুপ একদম চুপ! আমার বাবাকে নিয়ে কোনো মিথ্যা কথা আমি তোর মুখ থেকে শুনতে চাই না। আমার বাবা এইসব কাজে কখনো লিপ্ত ছিল না।”
নিহানে গলা টিপে দিয়ে চিৎকার করে কথা গুলো বললো অরিত্রি। নিজের বাবার বিরুদ্ধে এইসব কথা যেনো সে মেনে নিতে পারছিলো না।
” তোর মতো নোংরা, পিতৃহীন ছেলে কি করে বাবার মূল্য বুঝবে? জীবনে কখনো বাবার আদর, স্নেহ পেয়েছিস? জানিস বাবার আদর কেমন হয়? সন্তানের প্রতি বাবা কেমন হয়?”
” তুমি আমাকে চুপ করিয়ে দিলেও সত্য কখনো মিথ্যে হবে না অরিত্রি। আমার হাতে কখনো কোনো নির্দোষের প্রাণ যায়নি। তোমার বাবার এতো নাম ডাক, টাকা সব কিছু ছিল অবৈধ উপার্জন করা। তোমার বাবার সব কুকর্মের কথা তোমার মা সব কিছু জানতেন শুধু মাত্র তোমাদের জন্য চুপ করে থাকতো। তোমার বাবার কাছে তোমার কথা শুনেছি কিন্তু আমি এইটা জানতাম না তুমিই তার মেয়ে। আর বাকি রইল তোমার বোনের কথা! তাহলে তুমি তার কাছে যাও যার জন্য তুমি আমার ভালোবাসা ভুলে গিয়ে আরেক জনের সাথে জড়িয়ে পড়িয়েছিলে।”
নিহানের শেষ কথা গুলো শুনে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আয়ানের দিকে তাকিয়ে আবারো নিহানের দিকে তাকায় অরিত্রি।
” আয়ান দিপ্তীকে চিনতো?”
“তোমার আশিককে জিজ্ঞেস করো। কি রে আয়ান তুই কিছু বল! তুই যে দিপ্তীকে চিনতি সেটা বল।”
পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা আয়ানের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো নিহান। নিহানের ঠোঁটে হাসি। বন্ধু এবং প্রাক্তনের সত্যি জানার পরেও চোখে মুখে কোনো বেদনা বা কষ্ট নেই। অপরদিকে দিকে আয়ান যেই ভয় পাচ্ছিল সেটাই যেনো ধীরে ধীরে বের হয়ে আসতে লাগলো। দ্রুত কিছু ভাবতে লাগলো।
“নিহান যা বলছে তা কি সত্যি আয়ান? কি হলো তুমি কিছু বলছো না কেনো আয়ান? তুমি চিনতে দিপ্তীকে?”
“তুমি আমার কথা গুলো শুনো অরি! প্লিজ কাম ডাইন।”
“অরিত্রি!”
অরিত্রিকে কথা গুলো বলতে বলতে অরিত্রিকে এক পা করে এগিয়ে আসতে থাকে আয়ান। যখনই অরিত্রির পিছনে এসে দাঁড়িয়ে গলা বরাবর ছুড়ি চালিয়ে দেয়। মূহুর্তের মাঝেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অরিত্রি। গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অরিত্রিকে এভাবে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়তে দেখা মাত্রই অরিত্রি বলে চিৎকার করে নিহান।
” এইটা তুই কি করলি আয়ান। অরিত্রিকে কেনো মারলি?”
” যেটা করেছি বেশ করেছি। কি ভেবেছিল আয়ানের সাথে ডাবল গেইম খেলবে? আয়ান একবার যেই কাজে হাত দেয় সে-ই কাজ কখনো অসম্পূর্ণ রাখে না। কিন্তু এর কৈ মাছের জান। ঠিক বেঁচে গেছে। কিন্তু এবার তো মরতেই হলো। আমার সব প্ল্যান জেনে যাচ্ছিল। এই মেয়েকে দিয়ে আমার একটু বিশ্বাস নেই। পুরানো প্রেম যদি আবার ফিরে আসে? আর আমার সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায়। এই এই শালি বড্ড বেশি কথা বলে। আমার এতো কথা বলা মানুষ পছন্দ না। ভেবেছিলাম অরি তোকে শেষ করবে তারপর আমি অরিকে করবো। কিন্তু তুই সবটা ঘেঁটে দিলি।”
কথা গুলো শেষ হতেই নিহানের বুকে লাথি দিয়ে ফেলে দেয় আয়ান।
” তুই তো আমার ভাই! বেস্ট ফ্রেন্ড আমার। তাহলে কি করে আমার সাথে এমন করলি?”
মেঝেতে পড়ে থাকা নিহানের কলার ধরে কথা গুলো বললো আয়ান। কিন্তু আয়ানের কথার উত্তর করলো না।
” ইউ নো এভরিথিং ফের এন্ড লাভ। তোর জন্য আমি সব সময় সেকেন্ড হয়েছি। তাই মনে মনে জেদ চেপে বসে আমাকে সব কিছুতেই প্রথম হতে হবে। তোর সাথে থেকেই তোরই ড্রাগস নিয়ে আমি আলাদা কাজ শুরু করলাম। কিন্তু দিপ্তী আমার সব কিছু দেখে নিয়ে ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইল করতে লাগলো। তাই তাকেও মেরে দিলাম। কিন্তু তুই হুট করে সিদ্ধান্ত নিলি ড্রাগ পুড়িয়ে দিবি। তাই আমি তোর পুড়িয়ে ফেলা ড্রাগস নতুন করে আবার শুরু করলাম। দেশের বাহিরে পাঠাতে শুরু করলাম।
আমার প্রিয় মানুষকে তুই বরাবর আমার থেকে কেড়ে নিয়েছিস। তোর থেকে আমার সব কিছু বেশি ছিল। টাকা পয়সা, গাড়ি বাড়ি, দেখতেও তোর থেকে অনেক বেশি সুন্দর এবং হ্যান্ডসাম কিন্তু তাও সবাই তোকে পছন্দ করে। কিন্তু কেনো করছ? তোর আগে আমি অরিত্রিকে ভালোবাসি কিন্তু অরিত্রি আমাকে ভালো না বেসে তোকে ভালোবাসলো। কিন্তু যখন আবারো অরিত্রি আমাকে ভালোবাসলো তখন তোর থেকে প্রতিশোধ নিতে আমিও ভালোবাসার নাটক করলাম কিন্তু তুই আবার আমার থেকে কেড়ে নিলি। আমার অবর্তমানে তোরা বিয়ে করে নিলি।তুই না আমার বন্ধু তাহলে কেনো এমন করলি আমার সাথে? তুই যেমন আমার থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়েছিস আমিও ঠিক তেমন করে সব কিছু কেড়ে নিবো। ওই দিকে তোর মা আর মেয়েকে শেষ করেছে এই দিকে এখন আমি তোকে শেষ করে দিয়ে তরীকে নিয়ে চলে যাবো।”
কথা গুলো বলে নিহানের পাশে থাকা শক্ত লাঠি দিয়ে আঘাত করে। শক্ত জিনিস দিয়ে কপালে আঘাত করার ফলে কপাল কেটে যায় এবং রক্ত ক্ষরণ হয়ে সম্পূর্ণ মুখে গড়িয়ে যায়।
” শালা! তোর জন্য আমার বাবা মা সবসময় আমাকে ছোট করেছে। ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে তুই সব সময় আগে ছিলি। তোর প্রতি রাগ আমার আজ থেকে না দীর্ঘ সময় ধরে। আজকে তোকে মেরে তরীকে নিয়ে এমন দূরে চলে যাব যেখানে কেউ থাকবে না। শুধু আমি তরী এবং আমাদের ভালোবাসা।”
কথা গুলো শেষ করেই আবারো নিহানের উপর আঘাত করতে যায় আয়ান। কিন্তু আঘাত করার পূর্বেই নিহান আয়ানের পেটে লাথি দিয়ে ফেলে দেয়।
” তুই কি ভেবেছিস সব কিছু করে যাবি আর কেউ কিছু জানতে পারবে না? তুই হয়তো ভুলে গিয়েছিলি তুই যেই গেইম খেলতে শুরু করেছিলি সে-ই গেইমের মাস্টার মাইন্ড আমি। তোর কি ধারণা, আমি জানিনা অরিত্রি বেঁচে আছে? আমি জানতাম। যখন অরিত্রির ফরেন্সিক রিপোর্ট পেলাম সেখানেই আমার প্রথম খটকা লাগে। এরপর যখন আমি আরেকটা রিপোর্ট দেখলাম যেখানে লাশের শরীরে ড্রাগস পাওয়া গেছে সেখানে আমার দ্বিতীয় খটকা লাগে। এই ড্রাগস আমি নিজের হাতে নষ্ট করে দিয়েছি সে-ই ড্রাগস আবার এলো কি করে?
জানিস তোর প্রথম ভুল কি ছিলো? আমার পিছনে লাগা। আমার জিনিসের দিকে নজর দেওয়া তোর দ্বিতীয় ভুল। তোর তৃতীয় ভুল তরীকে কিডন্যাপ করিয়ে আবার নিজেই হসপিটালে নিয়ে যাওয়া। তোর চতুর্থ ভুল, সোহেলের মতো গাধাকে ব্যবহার করা। আর তোর পঞ্চম ভুল, তোর অফিসের কর্মী ঐশীকে পাঠানো। তোর কি ধারণা নিহানের বাড়িতে যে কেউ চলে আসতে পারে? নিহান কোনো খুঁজ না নিয়ে বাড়িতে রেখে দিবে? এতোই সহজ নিহানের নাকের নিচে দিয়ে সব কিছু করে যাবে আর নিহান কিছু জানবে না? আবার হুট করেই কাজের মেয়ে ঐশী আমার বাড়িতে আসা, রাতের অন্ধকারে আমাকে ফলো করা, খালার কথা বলে মর্ডান মেয়েদের পোশাক পড়ে বাহিরে বের হওয়া, দামি গাড়িতে চলা এইসব আমি কিছু জানবো না?”
কথা গুলো বলেই আয়ানের পায়ে বারি মারে নিহান। পায়ে বারি মারার সাথে সাথে চিৎকার পায়ে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে।
” আমি সব কিছু জেনে শুনে তোর সাথে নাটক করে গিয়েছি। তোর চালেই তোকে মারার প্ল্যান করি। তুই আমাদের এখানে নিয়ে এসেছিস? না! বরং আমি তোদের এখানে নিয়ে এসেছি। তুই আমাকে নিঃস্ব করে দিবি? ওয়েট তোকে লাইভ ঝটকা দেখায়।”
কথা গুলো বলে আবারো আয়ানের হাত এবং পায়ে আরো কত গুলো বারি দিয়ে আয়ানের হাতের উপর পা রেখে পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে ফোন করে নিহান। একবার রিং হতেই অপর প্রান্ত থেকে ফোন রিসিভ করতেই স্ক্রিনে থাকা মানুষ গুলো দেখে মুহূর্তের মাঝেই চোখে মুখে রাগ ফুটে উঠল আয়ানের।
“আমাকে ঠকিয়েছে! আয়ানকে ঠকানোর শাস্তি পেতেই হবে।”
ফোন থেকে নজর সরিয়ে নিচ থেকে উঠতে গিয়ে কথা গুলো বলে আয়ান। কিন্তু নিহান আবারো আঘাত করে আয়ানকে। যার ফলস্বরূপ উঠে দাঁড়াতে পারে না।
“তুই আমাকে শত্রু মনে করলেও আমি তোকে বন্ধুর কম ভাই ভেবে এসেছি। তুই আর অরিত্রি যখন আমার ভালোবাসার মূল্য না দিলি তখনও আমি তোকে ভাই ভেবে এসেছি। কিন্তু তুই যে আমার ভাই হওয়ার যোগ্যতা রাখিস না। আমার পিছনে আমার হয়েই শত্রুতা করিস। তুই যাদের দিয়ে আমার পিছনে লেগে ছিলি তাদের আমি অনেক আগেই নিজের করছ নিয়েছি। দেখলি তো কার পাওয়ার বেশি। তোর সব দুই নাম্বারী কাজের সব কিছুর প্রমাণ চলে গেছে পুলিশের কাছে। হাজার হাজার মেয়ে বিদেশে পাচার করেছিস সেই সব কিছু এখন পুলিশের কাছে। আজকে তুই এখান থেকে বেঁচে ফিরলেও বাহিরে তোকে সাধারণ জনতা ছিঁড়ে খাবে। আর তুই আমার তরীকে আমার থেকে নিয়ে যাবি। এতোই সহজ? এই নিহানের দেহে যতদিন প্রাণ আছে তুই ছুঁয়েও দেখতে পারবি না। আর একটা কথা বলি শোন, নিরাত্রি তোর আর অরিত্রির মেয়ে। কিন্তু নিরাত্রি সহ সম্পূর্ণ দুনিয়ার কাছে নিরাত্রি আমার মেয়ে। হ্যাঁ সে আমার মেয়ে।শুধু আমার মেয়ে। আমার দুনিয়ার অংশ।”
শেষ বারের মতো কথা গুলো বলেই আয়ানের মাথায় বারি দিয়ে বসে নিহান।না। মুহূর্তের মাঝেই মাথা দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হয়ে আসে এবং সম্পূর্ণ ফ্লোর ছেয়ে যায়। সেকেন্ডের মধ্যেই মৃত্যু ঘটে আয়ানের। সত্যি কথা জানার পর আয়ানের ভাবমূর্তির অপেক্ষা করলো না সে। কেনো করবে? নিরাত্রি তার মেয়ে। শুধুই তার। কাউকে নিরাত্রির ভাগ দিবে না।
অবেলায় এলে তুমি পর্ব ২৮
দূরে কোথাও থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। মানে সময় এখন ভোর। হাতে থাকা লোহার রড ফেলে দিয়ে তরীর দিকে এগিয়ে যায় নিহান।