অবেলায় এলে তুমি - bhuapurnews24

অবেলায় এলে তুমি পর্ব ২৪

অবেলায় এলে তুমি

অবেলায় এলে তুমি পর্ব ২৪
তামান্না ইসলাম কথা

তিনটা বেজে ছাপ্পান্ন মিনিট। এয়ারপোর্টে এসে দাঁড়িয়ে আছি একা। এক ঘন্টা পর ফ্লাইট। নিহানের হঠাৎ করে কল আসায় ফোনে কথা বলছে একটু দূরে গিয়ে। যখন নিহান বললো আমার জন্য সারপ্রাইজ আছে সাথে দুটো টিকিট তখন কিছুটা অবাক হই। তার থেকেও বেশি অবাক হয়ে যায় যখন বলে, নিরাত্রিকে ছাড়া আমরা নিজেদের একান্ত সময় কাটাতে যাচ্ছি তাও এক সপ্তাহের জন্য। এইটা নিয়ে কিছু সময় বাক বিতণ্ডা হয়। পরে একসময় শাশুড়ি আম্মা আশ্বস্ত করেন এই এক সপ্তাহ সে নিরাত্রির সম্পূর্ণ আপডেট আমাকে দিবে। আর আম্মা নিজেও ফুপির বাড়ি থেকে গতকাল সন্ধ্যায় চলে এসেছে। আম্মা এবং নিহান আশ্বস্ত করায় নিরাত্রিকে ছাড়া যেতে হচ্ছে।

” স্যরি একটু দেরি হয়ে গেলো। এবার চলো।”
নিহানের কথার প্রেক্ষিতে মুখ বাঁকিয়ে আমি আগে আগেই চলে গেলাম। এই লোকের উপর থেকে আমার এখনো রাগ কমেনি। কি ভেবেছে ঘুরতে নিয়ে যাবে আর আমি হাসিমুখে মেনে নিবো। উহু! কখনো এইটা হবে না। একে তো আমাকে কিছু বলেনি মেয়েটার কথা আবার রাতে ডাইনি বলেছে আমি মনে হয় সব কিছু ভুলে বসে আছি।

আরও গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন  

” স্যার সব কাজ কমপ্লিট। সব কিছু ঠিক মতো পৌঁছে গেছে। আপনি আর কোনো চিন্তা করবেন না।”
নিহানকে বিদায় দিয়ে নিজ বাড়ির দিকে যাচ্ছিল আয়ান। বাড়ির সামনে আসতেই কেউ একজন ফোন দিয়ে কথা গুলো বলতেই ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে কল কেটে দিলো। নিজের প্লান আবারো সাকসেস হতেই মনে মনে খুশি হয়ে যায়।

” বাহ্! আয়ান তুই তো জিনিয়াস। তোর মাথায় সত্যি সবসময় প্লান রেডিই থাকে। নিজেকে কি ভাবে সেফ করতে হয় সেটা খুব ভালো করেই জানিস। কি ভাবে এক ঢিলে দুই পাখি, উহু! দুই পাখি না বরং তিন পাখি মারতে হয় সেটা খুব ভালো করেই জানিস। আয়ান তোকে নোবেল দেওয়া উচিত নয়তো বইয়ের পাতায় তোর নাম লিখে ফেলা উচিত। নিহান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে এবার। আমার পিছনে লাগতে এলে এর পরিনতি যে খুব ভয়ংকর হয় নিহান। খুব ভয়ংকর!”

নিজেকে বাহবা দিতে দিতে কথা গুলো বললো আয়ান। নিজের কাজে সে মহা খুশি। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু খুশি মনে বাড়িতে ফিরলেও সদর দরজা দিয়ে প্রকাশ করার পর পরই মুখের হাসি মিয়ে যায়। শুধু মিয়ে না বরং চোখে মুখে ভয়ের রেখা ফুটে ওঠে। সে-ই চিরচেনা মুখ তার সামনে। কিন্তু কি ভাবে এইটা সম্ভব? যেখানে সে নিজেই সব কিছু শেষ করেছিল সেখান থেকে কি ভাবে ফিরে আসতে পারে? নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব কিছুর সাক্ষী হয়েছিল তাহলে কি ভাবে সম্ভব এইটা? ভয়, কৌতুহল আর মনে হাজার প্রশ্ন নিয়ে ধীরে পায়ে ভিতরে প্রবেশ করে। যত ভিতরে প্রবেশ করছে ততই মনের মাঝে ভয় আর প্রশ্নরা নাড়া দিয়ে উঠছে।

” আরে তুমি এতো ধীরে ধীরে আসছো কেনো আয়ান? তাড়াতাড়ি করে আসো আমি সেই কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। এই দেখো তোমার জন্য অপেক্ষা করতে, করতে আমার প্রচন্ড ক্ষুধা লেগে গিয়েছিল আর আমি খাওয়া শুরু করেছি। তুমিও আসো তাড়াতাড়ি করে। আসো! আসো!”
কথা গুলো বলে মেয়েটি আবারও খাওয়ার দিকে মন দিল। কিন্তু ডায়নিং টেবিলে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখে আয়ানের মুখাবয়ব ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে লাগল। কিন্তু মেয়েটা সেই দিকে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন না মনে করে নিজের মতো করে শুধু খাবার খেয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, মেয়েটির একমাত্র উদ্দেশ্য খাবার খাওয়া। আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে সবে কিছু যায় আসে না।

” তুমি এখানে?”
” হুঁ আমি! এতো অবাক হয়ে যাওয়ার কি আছে?”
খাবার মুখে দিতে দিতে আয়ানকে প্রশ্ন করলো মেয়েটি। কিন্তু আয়ান সে-ই সব কথা কানে তুললো না। সে এখনো অবাক চোখে মেয়েটিকে দেখে যাচ্ছে। আদৌও কি সম্ভব? কি ভাবে সে ভুল হতে পারে? আর ডঃ সেন যে আমাকে ঔষধ ইনজেকশন দিয়েছিলো সেটা দেওয়ার পর কী ভাবে বেঁচে থাকতে পারে?
” তুমি কি আমাকে এভাবে ঘুরে ঘুরে দেখা বন্ধ করবে আয়ান? তুমি আমাকে কি চিনতে পারছো না না কি? আমাকে দেখে তোমার ভূত মনে হচ্ছে? না কি তুমি আমাকে কখনো দেখোনি? কোনটা বলো তো?”

এবারো আগের মতো নিশ্চুপ আয়ান। কি উত্তর দিবে আয়ান? আয়ান এখনো নিজের চোখের সামনে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কিন্তু সামনে বসে থাকা মেয়েটির যেনো এতে খুব সমস্যা হয়ে গেলো। তাই সে চেঁচিয়ে উঠলো।
” তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? তুমি জানো না আমার খাওয়ার সময় এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার খাওয়ায় সমস্যা হয়? আর এভাবে চুপ করে আছো কেনো?”

সামনে থাকা খাবারের প্লেট এক প্রকার ছুড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে কথা গুলো বললো মেয়েটি। ফ্লোরে প্লেট পড়তেই সেটা ভেঙ্গে কয়েক খন্ডে খন্ডিত হয়ে এদিক ওদিক পড়ে রইলো।
কিন্তু আয়ান তখনো একই ভাবে মেয়েটিকে দেখে যাচ্ছিল। সেই আগের মতো রাগ, কথা বলার ধরণ, সে-ই চেহারা। কিছুই যেনো পাল্টাইনি। এই তো সেই তিল যেখানে সে কতবার নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছিল, এই চোখে চোখ রেখে কথা ভালোবাসা, আবেগ দেখে ছিলো। কিন্তু মুহূর্তের মাঝেই সব কিছু কেমন জানি স্বপ্নের মতো ভেঙে গেলো।
” তুমি বেঁচে আছো? কিন্তু কি ভাবে? ওরা যে তোমাকে কবর দিয়েছিল?”
আয়ানের মুখে প্রশ্নটা শুনে মেয়েটি ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। মেয়েটির কাছে যেনো মনে হলো, সে কোনো মজার কৌতুক শুনেছে।

” হুম! আমি তো মরেই গিয়েছি। এখন তোমার সামনে অশরীরী আত্মা হয়ে কথা বলছি।”
আয়ানকে কথাটা বলে আবারও হাসতে লাগলো মেয়েটা। আয়ানের মুখাবয়ব মেয়েটিকে এক আলাদা আনন্দ দিচ্ছে।
” এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমার না পাঁচটার ফ্লাইট আছে। তাহলে যাও এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে আসো। আমি তো রেডি হয়ে আছি এখন তুমি এলেই আমরা রওনা হবো।”
কথা গুলো বলে মনে মনে হাজার কল্পনা জল্পনা করে নিলো মেয়েটি। এই দিকে আয়ান চুপ করে কথাটা গিলে নিলো। মেয়েটি কে তাকে নিয়ে ভাবার সময় এখন তার হাতে নেই। যেই হয়ে থাকুক না কেনো এই মেয়েকে সরিয়ে দিতে হবে। আর মেয়েটি যে তার বিষয়ে সব তথ্য নিয়েই এসেছে সেটাও বুঝার অবকাশ নেই। যার জন্য এখন কথা না বাড়িয়ে চুপ থাকা ভালো মনে হলো।

” মিস্টার আয়ান! তুমি কি ভেবেছিলে আমি কিছু জানিনা? উহু! তুমি ভুল আয়ান, তুমি ভুল। তোমাকেও যে শাস্তি পেতে হবে আয়ান জান। আমাকে তো আজকে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে তোমার জন্যই। আমার এই পরিণতির জন্য শুধু নিহান না বরং তুমিও সমান ভাবে দোষী আয়ান। আমার ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে তুমি আমাকে ঠকিয়েছ আয়ান। যখন আমার তোমাকে প্রয়োজন ছিলো তুমি ছিলে না আয়ান! ছিলে না। আমার ভালোবাসার সুযোগ নেওয়ার জন্য তোমাকে আমি কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি পেতে হবে আয়ান।”
আয়ান নিজের রুমে চলে যেতেই নিজে নিজেই কথা গুলো বলে আবারও ঠোঁটের কোণে বাকি হাসি নিয়ে ফোনে কিছু একটা করে টেবিলে বসে পড়লো।

আমাদের রিসোর্টে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে ছয়টা বেজে যায়। রিসোর্টে আসা মাত্রায় নিহান রুমের চাবির জন্য রিসেপশনে চলে যায়। পিছন পিছন আমিও গিয়ে দাঁড়ায়। রিসেপশনে থাকা ছেলেটি নিহানের পিছনে থাকা আমার দিকে আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছিলো যেটা আমার নজরে পড়ে যায়। হঠাৎ করে নিহানকে শায়েস্তা করার জন্য মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো।

” এক্সিকিউজ মি! ভাইয়া আপনাদের এখানে কি রুম হবে? আমার একটা রুম লাগবে।”
নিহানকে পিছনে ফেলে ঠোঁটে লম্বা হাসি নিয়ে রিসেপশনে থাকা ছেলেটিকে প্রশ্ন করতেই চোখ মুখ চিকচিক করতে লাগলো।
” জ্বী ম্যাম আছে!”
“তুমি রুম দিয়ে কি করবে? আমাদের জন্য অলরেডি রুম বুক করা আছে। তাহলে তুমি রুমের কথা কেনো জিজ্ঞেস করছো?”

রিসেপশনিস্টকে আমি কিছু বলার আগেই নিহান আমার হাত ধরে পাশে নিয়ে কথা গুলো বললো। কিন্তু আমি নিহানের কথায় ” আই ডোন্ট কেয়ার ” ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আবারো রিসেপশনের ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে হাত নাড়িয়ে “হাই” জানায়।

” তুমি কি করছো তরী? তোমার বর তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর তুমি একটা ছেলেকে হাই দিচ্ছ?”
” এই ভাই কে আপনি? আপনাকে আমি চিনি? কোথাকার কে না কে। সরুন তো সামনে থেকে।”
নিহানকে কথা গুলো বলে আবারও রিসেপশনের দিকে চলে গেলাম। ছেলেটার মুখ খুশিতে গদগদ করছে।
” হেই বয়! তুমি প্লিজ আমাকে একটা রুম দেও। নাম হচ্ছে, তরী। শুধু তরী! লাক্সারি রুম দিবে ঠিক আছে? আর হ্যাঁ আমার ল্যাকেজ গুলো একটু রুমে দিয়ে আসবে। প্লিজ!”

কন্ঠ খাদে নামিয়ে এবং একটু মুগ্ধতার সাথে কথা গুলো বলতেই ছেলেটা দ্রুত মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। আমিও একবার নিহানের দিকে তাকিয়ে ভ্রু দয় নাচিয়ে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম।
” আর রুম লাগবে না। আমাদের জন্য রুম বুক করে আছে আমাদের জন্য একটা রুম ঠিক আছে।। এন্ড ইউ ! এতো গদগদ হওয়ার কিছু নেই। শি ইজ মাই ওয়াইফ।”

অবেলায় এলে তুমি পর্ব ২৩

কথা গুলো বলে আমার হাত ধরতে আসলেই আমি সেখান থেকে সরে যায়।
” হো আর ইউ ম্যান? নিজের স্ত্রীর কাছে গিয়ে কথা গুলো বলেন। এন্ড ইউ ক্যাম বেবি।”
প্রথম কথা নিহানকে বলে পরের কথা গুলো রিসেপশনিস্টকে বলে আমার রুমের চাবি নিয়ে চলে গেলাম। আর নিহান সেখানে বেয়াক্কেলল মতো কিছু সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কিছু বুঝে উঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু নিহান বৃথা। তার মাথায় কিছু আসছে না। সব কিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বউ এক রুমে থাকবে আর সে এক রুমে। এও কি হানিমুনে সম্ভব?

অবেলায় এলে তুমি পর্ব ২৫