অবেলায় এলে তুমি পর্ব ২৩
তামান্না ইসলাম কথা
রাগ, আর অভিমান নিয়েই তেল আর কিছু খাবার গরম করে নিয়ে রুমে এলাম। কিন্তু রুমে এসে দেখি সম্পূর্ণ রুম ফাঁকা, নিহান রুমে নেই। খাবার আর তেল টেবিলের উপর রাখতে গেলেই ওয়াশরুম থেকে শব্দ ভেসে আসে। ময়লা পানি শরীরে পড়ায় শাওয়ার নিচ্ছে ভেবে আলমারি থেকে নিহানের জন্য জামা কাপড় বের করতে লাগলাম আনমনেই। কেনো যেনো মস্তিষ্ক থেকে বিকেলের দৃশ্য গুলো মুছে ফেলতে পারছিলাম না।
ক্ষণে ক্ষণে দৃশ্য গুলো মনে পড়ছিল। নিজের স্বামীর সাথে একটা অচেনা মেয়েকে ঢলাঢলি করতে দেখে কারই বা ভালো লাগে? আবারো চোখের কোণে জলরাশির হাতছানি দিচ্ছে। বারবার চোখের পলক ফেলে নিজেকে সামলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি।
আরও গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
” তুমি কি ভেবেছিলে আমার সাথে এমন করে পার পেয়ে যাবে বেবি? উহু! নিহানকে কিছুর বিনিময় রাখে না বেবি। নিহানকে দিলে নিহান সেটার বিনিময়ে তীব্র ভালোবাসা, জ্বালা গিফট করে। আর নিজের একান্ত মানুষ হলে এর জ্বালাও অনেক বেশি। নিহানের রগে রগে প্রতিশোধ লেখা আছে।”
আলমারি থেকে জামাকাপড় বের মাত্রই সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এরই মাঝে ঠোঁটে তীব্র ভাবে জ্বালা অনুভব হয়। নিজের নরম ঠোঁট এবং কোমরে তীব্র ভাবে জ্বালা অনুভব হতেই চোখ দিয়ে আপনাআপনি টপটপ করে বর্ষন হতে শুরু করলো। কিন্তু সামনের মানুষের সে-ই দিকে তোয়াক্কা না করে নিজের কাজ হাসিল করতে লেগে গেল আবারো। নিহান হাতের নখ কোমরের মাংসপেশীতে গেঁথে যাওয়ায় ব্যাথা অনুভব হয় সাথে ঠোঁটের উপর নিজের যেই রাগ দমিয়ে রেখেছিল সবটা ঝেড়ে নিচ্ছে তা স্পর্শে বুঝতে পারি।
নিজের মস্তিষ্কে আবারো সেই বিকেলের দৃশ্য ভেসে উঠতেই নিজের শরীরের সব শক্তি দিয়ে নিহানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম।
” একদম আমার কাছে আসবেন না। স্টে এওয়ে ফর মী। খাবার আর তেল নিজে দিয়ে নিবেন।”
কান্না ভেজা চোখ কথা গুলো বলে নিহানের সামনে থেকে চলে আসি। আর নিহান হতভম্ব হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। আমার এমন ব্যবহার, কান্না নিহানের কিছুই বোধগম্য হলো না। নিহান এখনো অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম আর যাওয়ার সময় সশব্দে দরজা লাগিয়ে দিলাম।
সকালের মিঠা মিঠা রোদ চোখে মুখে লাগতেই ঘুম হালকা হয়ে গেলো। কিন্তু দুই চোখের পাতায় ঘুম ছাড়া কিছুই দেখছি না। কিন্তু রোদ চোখে মুখে লাগায় বড্ড সমস্যা সৃষ্টি করছে। ঘুমের ঘোরে পাশে হাতড়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কাঙ্খিত জিনিসের অস্তিত্ব না পেয়ে মুহূর্তের মাঝে ঘুম উধাও হয়ে গেলো। শোয়া থেকে উঠে পাশ ফিরে নিরাত্রিকে না দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা আমার কোথায় গেলো? রাতে তো আমার কাছেই ছিল আর রুম ভিতর থেকে লক করা তাহলে গেলো কোথায়?
” আপনি এখানে শুয়ে আছেন কেনো? আর নিরাত্রিকেই বা কখন নিলেন?”
নিরাত্রিকে পাশে দেখতে না পেয়ে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে সোফায় দৃষ্টি যেতেই চোখ আটকে যায়। নিহান নিরাত্রিকে বুকের উপর নিয়ে শুয়ে আছে। আর মেয়েও বাবার গলা জড়িয়ে আরাম করে শুয়ে আছে। কিন্তু বিছানা থাকতে নিহানের এখানে এসে এভাবে শুয়ে থাকার হেতু বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলাম।
” নিরাত্রি ঘুম থেকে উঠে গিয়েছিল। আর তুমিও দেরিতে ঘুমিয়েছ বলে আর ডাকাডাকি করিনি। নিজের কাছেই নিয়ে এসেছিলাম।”
কথা গুলো বলে সোফা থেকে উঠে নিরাত্রিকে বিছানায় শুয়ে দিলেন।
” কিন্তু আপনি এখানে কেনো শুয়ে ছিলেন? এতো বড় বিছানা থাকতে আপনি এই সোফায় কেনো?”
নিহানের পিছনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম কিন্তু সে আমার কথা শুনেও না শোনার ভান করে ফোন নিয়ে বসলো।
” কি হলো উত্তর দিচ্ছেন না কেনো?”
” তোমার কথার মাঝেই উত্তর আছে। আর প্লিজ এখন একটু চুপ করে থাকো।”
ফোনের দিকেই দৃষ্টি রেখে কথা গুলো বললো নিহান। এক বার আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলার প্রয়োজন মনে করলো না। ফোনে কিছু একটা করে শটান হয়ে আবারও শুয়ে পড়লো। আর চুলে হাত দিয়ে মাঝে মাঝে একটু পরে চুল টেনে নিচ্ছে। এই সবটা সম্পূর্ণ ভাবে অবলোকন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।
রুমে ফিরে এলাম মিনিট দশেক পর।
” মাথা ব্যাথা করছে বললেই হয়ে যায়। পুরুষ মানুষ হয়ে এতো ঢং কেনো যে করতে যায় এরা আল্লাহ মালুম।”
কথাটা বলে বেড সাইড টেবিলে শব্দ করে কফির কাপ আর একটা বাম রেখে দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলাম। যতই রাগ, অভিমান থাকুক না কেনো নিহান আমার স্বামী। যাকে আমি নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছি।
যে কোনো সম্পর্কে রাগ, অভিমান, ঝগড়া থাকবেই তার মানে এই না সম্পর্কের ভালোবাসার আগে রাগ, অভিমান বেশি প্রাধান্য পাবে! সম্পর্কে রাগ, অভিমান, অভিযোগ, ঝগড়া আছে বলেই সম্পর্ক গুলো এতো মধুর।
যেই মানুষ গুলো সম্পর্কে রাগ, অভিমানের আগে নিজেদের ভালোবাসা আগে রাখে সে-ই সব সম্পর্ক গুলো টিকে থাকে শেষ পর্যন্ত। ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, স্বামী-স্ত্রী যে কোনো সম্পর্কে রাগ, অভিমানকে বেশি প্রাধান্য না দিয়ে বরং ভালোবাসা এবং সম্পর্ক গুলোকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত। রাগ, অভিমান বেশি প্রাধান্য দিতে গেলে দেখা যায় সম্পর্ক গুলো আর আগের মতো থাকে না। আগের মতো সম্পর্ক গুলো জুড়ালো থাকে না। রাগ, অভিমানের জন্য সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তি চলে আসে এবং তৃতীয় ব্যক্তি বেশি দামি হয়ে উঠে আর আগের সম্পর্ক গুলো নষ্ট করে তুলে। তাই রাগ, অভিমান বেশি প্রাধান্য না দিয়ে ভালোবাসা বেশি প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন।
সকাল সকাল ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আয়ানের। বিরক্ত হয়ে ঘুম জড়ানো চোখে ফোনের স্ক্রিনে থাকা নাম্বার খেয়াল না করেই ফোন রিসিভ করে। কিন্তু ওপারে থেকে ভেসে আসা কথা গুলো শুনে ঘুম চোখ থেকে না-ই হয়ে গেলো। শোয়া থেকে উঠে বসলো সে।
” কি বললে তুমি? আর ইউ সিউর?”
” জ্বী স্যার! পুলিশের রেড পড়বে যে কোনো সময়। স্যার এতো গুলো মাল কোথায় রাখব? কোথায় নিয়ে যাবো?”
ফোনের ওপাশে থাকা লোকটার কথা শুনে কিছু সময় চুপ করে ভাবলো আয়ান। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে। ঘুম থেকে উঠে যেনো মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আছে।
” আমি তোমাকে পরে জানাচ্ছি। আমি না বলা পর্যন্ত কোনো কিছু করবে না। আমি তাড়াতাড়ি দেখছি কি করা যায়। আর হ্যাঁ পুলিশ আসার আগেই আমি সম্পূর্ণ গোডাউন খালি দেখতে চাই। একটা সিঙ্গেল পরিমাণের ড্রাগস যেনো অবশিষ্ট না থাকে। সম্পূর্ণ গোডাউন ক্লিন করে ফেলবে। আমি আধঘণ্টার ভিতরে আসছি। এখন রাখছি।”
কথা গুলো বলে ফোন কেটে দিল আয়ান। দুহাত দিয়ে চুল টেনে ধরে দিলো। কিছু সময় রুমের ভিতর পায়চারি করে কিছু একটা ভাবতেই বাঁকা হেসে নিল।
” আমি একটা ঠিকানা দিচ্ছি মাল গুলো সেখানে নিয়ে যাবি। কয়েকজন আধমরা লোক পাবি তবে ভয়ের কিছু নেই। তাড়াতাড়ি করে সব ডেলিভারি করবি। ওকে!”
আবারো সে-ই নাম্বারে ফোন দিয়ে কথা গুলো ওয়াশরুমে চলে গেলো সিস বাজাতে বাজাতে। একটু আগে যেই চিন্তা, ভয় আয়ানের চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল মুহূর্তের মাঝেই সেই ভয় কোথায় জানি মিলিয়ে গেলো।
বেলা এগারোটা বাজে। নিরাত্রিকে ফ্লোরে বসিয়ে দিয়ে কিছু নোটস্ লিখছিলাম। একমাস পর পরীক্ষা এই দিকে নানান ঝামেলায় ঠিক মতো কিছুই করতে পারছি না। এই নোটস্ গুলো তিনদিন আগে তিথি দিয়েছিল যা আমি আজকে লিখতে বসেছি। সম্পূর্ণ বাড়িতে আমি, মামী, কাজের খালা আর নিরাত্রি। পুরুষ সবাই বাহিরে। হুট করেই মামা গিয়েছে জেসিকার বাড়িতে সাথে গিয়েছে এই বাড়ির নবাব পুত্র। যদিও চেয়েছিলেন বিকেলের দিকে যেতে কিন্তু সোহেল ভাইয়া জোর করে এখনই নিয়ে গেলো। আর নিহান নিজেও অফিস চলে গিয়েছে ঘন্টা খানেক আগে। কিন্তু এরই মাঝে আবারো ফিরেও এসেছে। শুধু নিহান নিজে একা না বরং আয়ান এসেছে সাথে করে।
” তরী তাড়াতাড়ি করে ব্যাগপ্যাক করে নাও।”
দু’টো এয়ার টিকেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে কথাটা বললো আয়ান।
” হঠাৎ করে ব্যাগপ্যাক করে নিবো কেনো? আর এই কাগজ কিসের?”
কোনো কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মতো আয়ানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।
অবেলায় এলে তুমি পর্ব ২২
” দিস্ ইজ সারপ্রাইজ ফর ইউ। যাও তাড়াতাড়ি করে ব্যাগপ্যাক করে নাও।”
প্রথম কথা গুলো কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেও শেষ কথা গুলো সাবলীল ভাবেই বললো নিহান। কিন্তু আমি এখনো কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম।