অবেলায় এলে তুমি পর্ব ২১
তামান্না ইসলাম কথা
গভীর রজনী। বাহির থেকে কুহুক পাখির ডাক ভেসে আসছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে শহর। সোডিয়ামের আলো এবং চাঁদের আলোয় অন্ধকার ডেঙিয়ে দিনের মতোই আলোকিত করে তুলেছে চারপাশ। ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছে আমি শূন্য ভেসে চলেছি। নিজের স্বপ্ন ভেবে আবারো আগের ন্যায় ঘুমিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করলাম। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে আমি শুধু শূন্যে ভেসে চলেছি না বরং পাশাপাশি উপরের দিকে অগ্ৰসর হচ্ছি।
দুচোখের পাতায় ঘুম থাকা সত্ত্বেও ঘুম জড়ানো চোখে তাকানো মাত্রই ঘুম চোখ থেকে বিদেয় নিলো। এতো সময় যেটা স্বপ্ন ভেবে এসেছি সেটা আমার স্বপ্ন নয় বরং সত্যি আমি শূন্য ভেসে চলেছি। কারো বলিষ্ঠ হাত এবং বুকের সাথে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে রেখেছে। কোমর এবং পেটের অংশে শক্ত করে চেপে ধরায় মাংসপেশীতে লাগছে। যার দরুন ব্যাথাও করছে। শূণ্যে ভাসানো লোকটাকে দেখতে গিয়ে ভয়ে বাকশক্তি লোপ পেয়ে যায়।
আরও গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
” চিৎকার করবে না। চিৎকার করলে এখান থেকে ফেলে দিয়ে কোমর ভেঙে দিবো। কি ভেবে ছিলে তোমার ফোন অফ করে রেখে আমাকে টেনশন দিয়ে তুমি আরাম মতো ঘুম আসবে? আর আমি বাড়িতে বসে থাকবো? তা কি করে সম্ভব হয় বউ বলতো? আমার সাথে লাগতে আসার শাস্তি তো পেতেই হবে।”
এমনিতেই এতো রাতে লোকটাকে এখানে দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তার উপর আবার ঠান্ডা গলায় কথা বলে আরো ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। তখন মামীর বলা কথা গুলো রাগিয়ে তুলেছিল আর সব রাগ গিয়ে পড়েছে বেচারা ফোনের উপর। যার ফলস্বরূপ ফোন দুখন্ড হয়ে পড়ে আছে আর এইটার জন্য ফোন অফ আর এই অসভ্য লোক ফোন দিয়ে না পেয়ে চলে এসেছে।
” আমাকে নিচে নামিয়ে দিন। আর আপনি এতো রাতে এখানে কি করছেন? ভিতরেই বা এলেন কি ভাবে?”
দাঁতে দাঁত চেপে কথা গুলো বলতেই নিহান ছাদের মাঝ বরাবর নিয়ে এসে নামিয়ে দিলো। নিজের যতটা রাগ, অভিমান, অভিযোগ ছিল সব চোখে মুখে ফুটিয়ে তুলে রেখে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু সামনের ব্যক্তি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে আমার দিকে চোখ ছোট ছোট করে দাঁড়িয়ে আছে।
” আমি কি ভাবে ভিতরে এসেছি সেটা তোমার না জানলেও চলবে। আর তুমি যেই আটার বস্তার মতো ভারি তোমাকে কোলে নিয়ে সিড়ি গুলো বেয়ে আসতে আসতে আমার হাত, পা সব শেষ হয়ে গেছে। কম কম করে খেতে পারো না? একটা আটার বস্তা।”
কথা গুলো বলেই হাত পা নিজে নিজেই টিপতে লাগলো। মনে হচ্ছে ব্যাথায় হাত পা খুলে খুলে পড়ে যাচ্ছে। যাক তাতে আমার কি? কিন্তু আমাকে আটার বস্তা বললো কোন দিক দিয়ে? আমি কি এতোই মোটা আর আমার ওজন এতোই না কি? আটার বস্তা বলায় তরতরিয়ে রাগ মাথায় উঠে গেলো।
” আমি আটার বস্তা?”
“হুম! তুমি তো আটার বস্তায়। কোনো সন্দেহ আছে নাকি? সন্দেহ হলে এই দেখো ব্যাথায় আমার হাত পা কেমন ফুলেফেঁপে উঠেছে।”
” আমার মতো স্লিম ফিগার মাত্র চল্লিশ কেজির মেয়ে আপনার কাছে আটার বস্তা?”
কোমরে দুই হাত দিয়ে নিহানের দিকে এক পা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলাম।
” মাই গড! তুমি চল্লিশ কেজি ওজনের মেয়ে হয়ে নিজেকে স্লিম ফিগার বলে দাবি করছো? তাহলে যারা সত্যি স্লিম ফিগারের তারা তো তোমার কথায় লজ্জা পেয়ে যাবে।”
অবাক হয়ে যাওয়ার ভান করে কথা গুলো বলে বারবার চোখের পলক ফেলতে লাগলো। নিহানের এমন ভান দেখে গা জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে মেরে তক্তা বানিয়ে দেয়। তুই ছেলে মানুষ ছেলে মানুষের মতো থাকবি। বউয়ের সুন্দর, সুন্দর প্রশংসা করবি। কিন্তু তুই তা না করে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ে মানুষের মতো ঢং করছিস কেনো?
” আমি যদি আটার বস্তা হই তাহলে আপনি একটা হাতি। শুধু হাতি না সাথে একটা জলহস্তী, গন্ডার, জিরাফ। দুনিয়ার সব আজগুবি প্রাণী আপনি। যদি নিজের বউকে কোলে নিতে না পারেন তাহলে হাতির মতো শরীর বানিয়েছেন কেনো? মেয়েদের নিজের এ্যাবস দেখাতে? না কি যারা হাসতে হাসতে গায়ে ঢলে পড়ে তাদের আগলে নিতে?”
এক নিঃশ্বাসে নিহানকে কথা গুলো বলে একটা দম নিলাম। কত বড় বদ হলে নিজের বউকে আটার বস্তা বলে। অথচ নিজে যে রাস্তাঘাট হেসে হেসে গায়ে পড়া মেয়েদের আগলে নেয় তখন একদম শক্তি চলে আসে।
” আমার এই বডি তো তাদের জন্যই। তারা গায়ের উপর এসে পড়ে যাবে আর আমি তাদের টুপ করে ধরে নিবো। কিন্তু তোমার মতো আটার বস্তাকে কোলে নিতে গিয়ে আমার কি অবস্থা হয়েছে তুমি নিজেই দেখো।”
কথাটা বলেই নিহান নিজের হাত আমার দিকে এগিয়ে দিলো দেখাতে তার হাত ফুলেফেঁপে উঠেছে। নিহানের হাত বাড়িয়ে দিতেই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। বুদ্ধিটা আসতেই মনে মনে নেচে নিলাম কিছু সময়। রাগি ভাব দূর করে মুখটা বাচ্চাদের ন্যায় করে নিলাম।
” তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে তাই না বাবু? দেখি দেখি কোথায় ব্যাথা করছে?”
কথাটা শেষ হতেই নিজের দাঁত গুলো বসিয়ে দিলাম নিহানের হাতে। সাথে সাথে নিহান মৃদু শব্দে চিৎকার দিয়ে উঠলো। এতো সময় ঢং করা আমার সাথে! এবার সত্যি সত্যি তোর হাতে আমি ব্যাথা করিয়ে ছাড়বো। ইচ্ছে মতো হাতে কামড়ে দিয়ে হাত ছেড়ে দিলাম।
” রাক্ষুসীর মতো আমার হাত কামড়ে দিলো। আল্লাহ আমার মা শেষ পর্যন্ত আমার জন্য একটা রাক্ষুসী বউ নিয়ে এসেছে। এই রাক্ষুসী তো আমাকে কামড়ে শেষ করে দিবে।”
এক হাত দিয়ে অপর হাত ধরে ঝেড়ে নিতে নিতে কথা গুলো। কিন্তু নিহানের এক হাত কামড়ে দিয়ে নিজেকে শান্ত করতে পারছিলাম না। তাই অপর হাত চেপে ধরে কামড় বসিয়ে কিছু সময় দাঁত দিয়ে ধরে রাখলাম। ব্যাথা পাচ্ছে তা নিহানের দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে রাখা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আমি সেদিকে তোয়াক্কা না করে নিজের রাগ মেটানো আগ পর্যন্ত হাত ছাড়লাম না।
” আমার হাত কামড়ে দেওয়া তাই না? তোমার এই দাঁত আমি হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলে দিবো। তুমি দাঁড়াও শুধু!”
কথাটা আমার কর্ণপাত হতেই আর এক মুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে ছাদের দরজার দিকে দিলাম দৌঁড়। কিন্তু কথায় আছে না, “অভাগী যে দিকে যায় নদী শুকিয়ে যায়।” আমার হয়েছে সেই অবস্থা। দৌড়ে আসতে গিয়ে ছাদের দরজার সামনে শাড়িতে পা আটকে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম। পড়ে যাওয়া মাত্রই পিছন থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসলো। নিহান যে আমার মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া নিয়ে হাসছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই দিকে আমার হাত জ্বালা করতে শুরু করেছে অপর দিকে নিহানের হাসি যেনো থামছেই না।
” এবার ভালো হয়েছে না? দেখলে স্বামীকে আঘাত করলে নিজেকেও আঘাত পেতে হয়। স্বামীর অবাধ্য হয়েছো তো এমন শাস্তি পেলে। বাবু খুব লেগেছে তাই না! দেখি! দেখি!”
আমার পাশে এসে কথা গুলো বলেই আবারো হাসতে লাগলো। এতো সময়ে আমিও পড়ে যাওয়া থেকে উঠে বসে পড়েছি। ব্যাডা মানুষ সত্যি বজ্জাতের হাড্ডি। হাতি গর্তে পড়লে চামচিকাও লাথি মারে। এই দিকে আমার কান্না চলে আসতেছে অপর দিকে নিহানের হাসি।
” শালা আমার পড়ে যাওয়া দেখে খুব হাসি পাচ্ছে তাই না। শালা আমি তোর বউ পড়ে গেছি কোথায় তুই আমাকে তুলে উঠাবি সেটা না করে তুই এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছিস আর হি হি হি করে দাঁত দেখাচ্ছিস। শালা ব্যাডা তোর বউ থাকবে না। থুক্কু এই ব্যাডার বউ তো আমি নিজেই। কি সব বলে চলেছি।”
মনে মনে কথা গুলো বলে নিহানের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম। নিহান আমার দৃষ্টির তোয়াক্কা না করে মুখ ভেংচে দিল।
“যে ভাবে পড়ে গিয়েছো সেই ভাবে উঠে আসো। আমার শরীরে এতো এনার্জি নাই আটার বস্তা তোলে রুমে নিয়ে যাওয়ার। যাই বাই অনেক রাত হয়েছে আমার ঘুম পাচ্ছে অনেক।”
কথাটা বলেই নিহান স্থান ত্যাগ করার পূর্বেই নিজেও আমার মতো মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। না! না! নিজে থেকে পড়ে যায়নি। আমি নিহানের পথে পা দিয়ে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছি। আমার পড়ে যাওয়া নিয়ে বড্ড হি হি হুঁ হুঁ করে হাসা হচ্ছিল। এবার দেখ কেমন লাগে পড়ে গেলে।
“কেমন লাগলো পতিদেব? নিজের বউ পড়ে যাওয়া দেখে অনেক হাসি হচ্ছিল তাই না? এবার নিজেও দেখেন বউয়ের উপর হাসির মজা। বউয়ের উপর হাসলে আল্লাহ পাক শাস্তি দেয় বুঝলেন।”
কথা গুলো বলে গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। নিহান উঠে দাঁড়ানোর আগেই আমাকে রুমে যেতে হবে নয়তো এই লোক একবার আমাকে ধরতে পারলে আমার সব দাঁত হাতে ধরিয়ে দিবে। তাই নিহান উঠার আগেই আমি নিজের রুমে চলে গিয়ে লক করে দিলাম। যাতে করে নিহান রুমে প্রবেশ করতে না পারে। আজকের রাত সে ড্রয়িং রুমে পার করুক। আমার রুমে আজকে তার ঠাঁই নেই। নেই মানে নেই। হুঁ!
অবেলায় এলে তুমি পর্ব ২০
” চোর! চোর! চোর! চোর এসেছে গো। বাড়িতে চোর এসেছে। কে কোথায় আছো তাড়াতাড়ি করে আসো। আমি চোর ধরেছি। চোর! চোর।”