অবেলায় এলে তুমি পর্ব ২০
তামান্না ইসলাম কথা
বিকেল হতেই নিরাত্রিকে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে। নিহান নাস্তা করেই বের হয়েছে কোনো জরুরি কাজে। আর শাশুড়ি আম্মা নিজেও এখনো ফুপি শাশুড়ির বাড়ি থেকে আসেননি। সে আসবে সন্ধ্যায়। তাই নিরাত্রিকে নিয়ে একাই বের হয়ে গেলাম। কিন্তু রাস্তায় বের হতেই রোদের উত্তাপে মনে হচ্ছে শরীর ঝলসে যাচ্ছে। সকালে ঝুম বৃষ্টি হলেও এখন উত্তাপ রোদের দেখা মিলেছে। তোলার মতো সাদা সাদা মেঘের ছড়াছড়ি।
বাহিরে বের হয়ে মনে হচ্ছে মস্ত বড় কোনো ভুল করে বসেছি। গাড়ির কাচ নামিয়ে দিতেই বাতাসে শরীর জুড়িয়ে গেলো। একবার নিরাত্রির দিকে তাকিয়ে দেখতেই দেখি মেয়ে আমার ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মেয়ে যে আমার গাড়িতে উঠলেই ঘুমিয়ে পড়ে আর এখনো তাই হয়েছে। সে ঘুমিয়ে পড়েছে আবার মামার বাড়ি যেতেই ঘুম থেকে উঠে যাবে আর সবার আগে সে যাবে মামীর কোলে। বুঝতে পারলাম না মেয়ে আমার মামীর পাগল হলো কি করে?
” ভাবীপু এই মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামাতে বললেন কোনো সমস্যা হয়েছে? গাড়ি বাড়ির দিকে নিয়ে যাবো?”
আরও গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলতেই ড্রাইভার উক্ত কথা গুলো বললো। গাড়ি করে কিছু দূর যেতেই কিছু একটা দেখে আমার নজর স্থির হয়ে গেলো। নিহান কোনো একটা মেয়ের সাথে রাস্তার কিনারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলছে। আর মেয়েটাও হাসতে গিয়ে যেনো নিহানের উপরে পড়ে যাবে। আর নিহান নিজেও মেয়েটাকে আগলে নিচ্ছে। আমার সব ভালো লাগা, সকল অনুভূতি মুহুর্তের মাঝেই ভেঙে শেষ হয়ে গেলো।
কোনো মেয়ে নিজের স্বামী, ভালোবাসার মানুষ, কাছের মানুষ বা প্রিয় যে কোনো কিছু অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখলে সহ্য করতে পারে না। মুখে যতই নিজেকে নরমাল দেখাক কিন্তু ভিতরে থেকে অসহ্য এক ব্যাথা অনুভূতি অনুভব হয়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। নিহানকে এভাবে কথা বলতে দেখে নিজেকে নিজের ভিতরে এক অজানা ঝড় বইতে লাগলো। এই মানুষটা আমার স্বামী, আমার ভালোবাসা। আর সেই মানুষকে অন্য কারো সাথে এভাবে দেখতে হবে ভাবতেই পারিনি।
” না। আপনি ভাইয়া তাড়াতাড়ি চলুন এখান থেকে। আমার শরীর খারাপ লাগছে।”
“ভাবীপু তাহলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চলি?”
” এতো কিছু ভাবতে হবে না আপনি চলুন।”
দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে ধরে নিজের কান্না দমিয়ে রেখে ড্রাইভারকে কথা গুলো বলে আবারও অশ্রুশিক্ত নয়নে নিহানের দিকে তাকালাম। অবাধ্য চোখ দুটো বারবার তাদের দিকেই চলে যাচ্ছে। দুচোখের অশ্রু আর ধরে রাখা সম্ভব হলো না। গাড়ি চলতেই অশ্রু গুলো অঝোর ধারায় ঝরতে লাগল।
অন্যদিকে অনেক দিন পর হঠাৎ করেই নিহানের রাস্তায় দেখা হয়ে যায় রিশাদের দুই বছরের বোন রিহার সাথে। মেয়েটা একটু গায়ে পড়া স্বভাবের কিন্তু মন থেকে অনেক ভালো। রিহাকে সবসময় বড় বোন হিসেবেই দেখে এসেছে, যার দরুন সম্পর্কও ভালো। রিহা এক জন চার বছরের জননী। সাংসারিক জীবনের পাশাপাশি নিজেও আইনজীবী পেশায় কাজ করেন। আকস্মিক দেখা হওয়ায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়েছে তাদের। আর রিহা কথায় কথায় প্রচুর পরিমাণে হাসি আর গায়ে এসে পড়ে।
” নিহান তুই তরীকে এখনো সত্যি কথা বলে দিচ্ছিস না কেনো?”
হাসি বন্ধ করে নিহানকে প্রশ্ন করে রিহা। অপরদিকে রিহার প্রশ্ন শুনে কিছু সময়ের জন্য চুপ করে গেলো নিহান।
“আপাই তুমি তো অরিত্রির বিষয়ে সব কিছু জানো। সে যতই ভুল করুক একটা সময় তো আমি ভালোবাসতাম তাকে। অরিত্রি আমার সাথে যেটা করেছে সেটা আমি প্রথমে মানতে না পারলেও নিজের ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমাকে মেনে নিতে হয়েছিল। তুমি তো জানো আমি অরিত্রিকে কতটা ভালোবাসতাম! আমি চেয়েছিলাম সব কিছু বলে দিতে কিন্তু আমি আমার ছোট্ট নিষ্পাপ মেয়েকে দেখে আর কিছু বলতে পারিনি। আমি নিরাত্রিকে ছাড়া থাকতে পারবো না আপাই। শুধু আমি না তরী যেই ভাবে নিরাত্রিকে আগলে রেখেছে সেখানে এই সত্যি কথা বলে দিলে যদি আমার মেয়েকে অনাদরে অবহেলা করে?”
” দেখ নিহান আমি তোর থেকে বড় সাংসারিক জীবনে আমার অভিজ্ঞতাও তোর থেকে অনেক বেশি। আর সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, মেয়েরা অনেক সেন্সিটভ হয়। ছোট, ছোট বিষয় নিয়ে মন খারাপ করে, অভিমান করে, রাগ করে কিন্তু নিজের প্রিয় মানুষকে ছাড়া খুব বেশি দূরে থাকতে পারে না। মেয়েরা হচ্ছে, মায়ের জাত। এরা নিজের সন্তান হোক বা রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান একবার যখন আগলে রাখতে শিখে যায় তাহলে সারাজীবন নিজের সন্তানের থেকেও তাদের ভালোবাসে আগলে রাখে।
তুই নিজের ক্ষেত্রেই দেখতে পারিস সব কিছু। যাই হোক আমি বলব তুই তাড়াতাড়ি করে তরীকে সব কিছু বলে দে। কোনো ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার আগেই সব কিছু বলে দেওয়ায় শ্রেয়।”
রিহার কথা গুলো মন দিয়ে শুনলো কিছু সময়। সব মা এক হয় না এইটা সে নিজেকে দিয়েই বুঝেছে। আর ভুল বোঝাবুঝি যে কোনো সম্পর্ক নষ্ট করতে পারে এইটাও সে জানে।
“তুমি আমার বেস্ট আপাই। তুমি খুব ছোট করে সহজেই যে কোনো সমস্যার সমাধান দিয়ে দাও। আমি খুব তাড়াতাড়ি তরীকে সব সত্যি বলে দিবো।”
খুশি মনে রিহাকে কথা গুলো বলে যে যার মতো স্থান ত্যাগ করলো। অপরদিকে দূর থেকে যে কেউ তাদের কিছু ছবি তুলে নিয়েছে সেটা আর কেউ খেয়াল করলো না। ছবি গুলো তুলে বাঁকা হেসে নিজেও স্থান ত্যাগ করলো।
রাত নয়টা বেজে গেছে। আমি এখনো মামার বাড়ি থেকে গেয়েছি। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, নিহান একটা ফোন পর্যন্ত করলো না। আমি তার বাড়ি ফিরবো না কি ফিরবো না সেও কথা জানার জন্য একটা ফোন করলো না। কষ্ট, রাগ, অভিমান, কান্না সব কিছু একসাথে নিজের উপর ভর করেছে। পুরুষ মানুষ সত্যি কখনো একজনে সীমাবদ্ধ থাকে না। এরা নতুনত্ব খুঁজে ফিরে।
” কি রে এমন করে বসে আছিস কেনো? নিহান কি আসবে না? ফোন করেছিল কি তোর কাছে? কি ছেলেরে বাবা! বউ বাচ্চার একটা খবরও নিলো না।”
আমার সামনের সোফায় মামী বসতে বসতে কথা গুলো বলেই মুখ ভেংচে দিলেন। এমনিতেই সব কিছু অসহ্য লাগছিলো। তার উপর মামীর এমন কথা শুনে ইচ্ছে করছে সব কিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।
” ছেলে কেমন সেটা জেনে কেনো এমন ছেলের সাথে বাড়ির মেয়েকে বিয়ে দিলে কেনো? ছেলে দুশচরিত্রা জেনেও কেনো বিয়ে দিতে গেলে? সব কিছু কি টাকার লোভে করলে?”
আমার কথা গুলো শুনতেই মামী কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। হ্যাঁ! সে ভেবেছিল তরীর বড়লোক পরিবারে বিয়ে হলে পরবর্তীতে ভুলিয়ে বালিয়ে সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নিবেন।
“তুই এইসব কি বলছিস? টাকার লোভে কেনো দিতে যাবো? তোর ভালোর জন্য আমি কিছু না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করেছি। আর শোন একটা কথা বলি, ছেলেরা একটুআধটু এমন হয়েই থাকে। কোনো পুরুষ মানুষ সাধু না বোঝলি।আর নারী হয়ে জন্ম নিয়েছো, মানিয়ে নিতে এবং মেনে নিতে শিখতে হবে। মেয়েরা হচ্ছে, কম্প্রোমাইজ করতে হয়। যত মানিয়ে নিতে পারবে, মেনে নিতে পারবে এবং কম্প্রোমাইজ করতে পারবে তত ভালো থাকবে এবং সংসারও টিকে থাকবে।”
কথা গুলো বলে আবারও মুখ ভেংচে দিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু আমার মাথায় শুধু বিকেলের সেই দৃশ্য মনে পড়ছে। কই নিহান তো কখনো আমার সাথে এতো হাসিখুশি ভাবে কথা বলেনি। যখন প্রয়োজন হয়েছে কাছে টেনে নিয়েছে, তাহলে আমি কি সত্যি শুধু নিহানের প্রয়োজন? আমার দেহখানাই কি শুধু প্রয়োজন?আর কোনো কিছু ভাবতে পারছিলাম না।
অবেলায় এলে তুমি পর্ব ১৯
মনে মনে ঠিক করলাম আমি আর নিহানের কাছে ফিরে যাবো না। আমি সব কিছু মেনে নিতে এবং মানিয়ে নিয়ে চলতে পারব না। যেই মানুষটি আমার সে শুধু আমার থাকবে। অন্য কারো সাথে আমি তাকে এক সেকেন্ডের জন্য সহ্য করতে পারবো না।
“চিৎকার করবে না। চিৎকার করলে এখান থেকে ফেলে দিয়ে কোমর ভেঙে দিবো।”