অবেলায় এলে তুমি পর্ব ১১

অবেলায় এলে তুমি

অবেলায় এলে তুমি পর্ব ১১
তামান্না ইসলাম কথা

প্রেম এবং ভালোবাসা সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। প্রেম আপনি কারো চোখে পড়বেন, কারো হাসির, কারো কথার বা কারো রুপের প্রেমে। এই প্রেম আপনি একটা সময় ধীরে ধীরে ভুলে যাবেন তো খুব বেশি প্রয়োজন না হলে হলে যখন স্মৃতির পাতায় হাত রাখবেন তখন মনে পড়ে আপনাকে খানিক সময়ের জন্য খুশী করবে। কিন্তু ভালোবাসা বা মায়ার চাদরে আটকে যাবেন তখন আর তার থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব না।

সম্ভব না এইটা ভুল বলা হয় তবে সম্পূর্ণ ভুল না। মায়া কাটিয়ে উঠতে নিজেকে ব্যস্ত রাখা প্রয়োজন, সবার সাথে নানান প্রসঙ্গে কথা বলা বা নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। আয়ান যখন নিজের অতীত ভুলে তরীর সাথে নিজের ভালোবাসা খুঁজে পেলো তখন আবার নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করে। সবসময় চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করতো কিন্তু একটু চোখের আড়াল হতেই যে তরী অন্য কারো হয়ে গেলো সেটা আয়ান মেনে নিতে পারেনি।

আরও গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন  

পুরানো ঘায়ে আবারো আঘাত পড়ে। যেই শত্রুতা ভুলে গিয়েছিল সেই শত্রুতা নতুন করে আবার জেগে উঠে। এবার মরণ খেলায় নিজেকে নিয়ে মেতে উঠে। ভুলে যায় সব সম্পর্ক প্রতিশোধের আগুন আবার জলে উঠে। এখন একটাই নেশা তরীকে নিজের করে পাওয়া। বন্ধুর জন্য মনে যেই ভালোবাসা ছিলো তা প্রিয় মানুষটিকে বন্ধুর সাথে দেখে বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে গিয়ে মনে শত্রুর বীজ রোপণ করে।

রাত আটটা বেজে পঁচিশ মিনিট। ড্রয়িংরুমে বসে বসে ল্যাপটপে অফিসের কিছু কাজ করছিল নিহান। পাশেই মেয়ে নিয়ে বসে আছি। নিরাত্রি বারবার কোল থেকে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যতবার ধরে রাখার চেষ্টা করছি ততবারই যেনো সে নেমে যাচ্ছে।

” বুঝলি নিরাত্রি আমি আর তুই হচ্ছি লিলিপুট। আমরা কারো নজরেই পড়ি না। সবার নজর তো শুধু এইদিকে সে-ই দিক নয়তো ল্যাপটপে পড়ে থাকে। আমাদের দিকে কারো নজরই নাই। চল মা! আমরা দুজনে বরং নানু বাড়ি চলে যায়। সেখানে আমাদের দেখার জন্য অনেক মানুষ আছে তাই না। চল আমরা রুমে গিয়ে নানাভাইকে ফোন করি যেনো এখনই চলে আসে।”

কথা গুলো বলে আড়চোখে একবার ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে এখনো আগের মতই ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে আছে। এইদিকে মেয়ে আমার কিছু বুঝলো না কিন্তু সে খিলখিল করে হাসতে লাগলো। বাপ মেয়ের এমন কাহিনী দেখে আমার হাত পা ছড়িয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। বাপে পাত্তা দিচ্ছে না তো মেয়ে জ্বালাচ্ছে।

” যার যেখানে ভালো লাগে যেতে পারে সমস্যা নাই। বরং আমার জন্য ভালো হবে। নতুন একজন আসবে, আমার সেবাযত্ন করবে। আমাকে ভালোবাসবে। তুমি বরং তাড়াতাড়ি করে চলে যাও। নয়তো আমি গাড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। মেয়ে মানুষ, বাচ্চা নিয়ে আর যাবে কি ভাবে? যাক ভালোই হলো নতুন কেউ আসবে এই ভেবে।”
কোনো দিক না তাকিয়ে ল্যাপটপে হাত চালাতে চালাতে কথা গুলো বললেন ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেলো। তাঁর নতুন চাই। ব্যাডা মানুষ সত্যি লুচি। এদের ঘরের থেকে বাইরের জিনিসে ইন্টারেস্ট বেশি।

” নতুন চাই তো? ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি। নতুন নিয়ে থাকুন। বাবা মেয়ে নতুন খুঁজে নিন। আর আমিও সুন্দরী কম না। একজন যাবে দশজন লাইন ধরে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমিও নতুন খুঁজে নিবো। এই নিন আপনার মেয়ে। আমি চললাম।”

কথা গুলো বলে নিরাত্রিকে নিহানের কোলে দিয়ে আমি রুমের দিকে অগ্ৰসর হলাম। এই দিকে নিহান হা করে তাকিয়ে রইল। মেয়ে আমার তখনো হেসেই যাচ্ছে।
“দরজা তো এই দিকে তাহলে তুমি উপরে যাচ্ছো কেনো?”
কথাটা শুনতেই কোমড়ে দুহাত দিয়ে রাগি দৃষ্টিতে নিহানের দিকে তাকাতেই সে বেকুবের মতো করে মাথা চুলকে হেসে দিলো।

রাত দুটো। আজকে আকাশে আর চাঁদ নেই। মেঘ করে আছে। প্রতিটি ঘরে ডিম লাইটের আলো বিদ্যমান। কিন্তু এই আলো ঘরকে আলোকিত করতে যথেষ্ঠ নয়। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে তরী। নিহান ঘুম থেকে উঠে চুপচাপ রুমের বাহিরে চলে গেলো। আজও সে-ই গেস্ট হাউসের দিকে অগ্ৰসর হয়। কিন্তু ড্রয়িংরুমে আসতেই ভিন্ন কিছু চোখে পড়ে নিহানের। নিজের ছায়া ছাড়াও আরেকটি ছায়া নিহানের পিছনে দেখা যাচ্ছে। সে-ই দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে সদর দরজা দিয়ে চুপচাপ বের হয়ে যায় নিহান।

“হ্যালো ডাক্তার সেন!”
টেবিলে বসেই মাথা নিচু করে বসে আছেন ড.সেন। মাথার পাশে কেটে যাওয়া অংশের রক্ত জমাট বেঁধে কালসিটে হয়ে আছে। না খাওয়া অবস্থায় যেনো আরো বেশি করে শরীর অসার হয়ে পড়ে আছে। নিহানের ডাক শুনে কোনো রকম মাথা তুলে তাকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। একই অবস্থায় এবং অভুক্ত থাকার কারণে শরীরে অবশিষ্ট শক্তি লোপ পেয়ে গেছে।

“আমাকে এখান থেকে যেতে দাও নিহান।”
ড. সেন এর সামনে বসতেই কোনো রকম আওয়াজ করে কথাটা বললেন তিনি। কিন্তু নিহান সেই দিকে আর কান দিলো না। নিজের মতো করে বসে ড.সেন এর দিকে তাকিয়ে রইল কিছু সময়।
“ড.সেন আমি যেই ড্রাগ গুলো পাঁচ বছর আগে পুড়িয়ে ফেলে দিয়েছিলাম। যার কোনো চিহ্ন আমি অবশিষ্ট রাখেনি সেই ড্রাগ আপনি পেলেন কোথায়? শুধু পাননি আপনি সেই ড্রাগ নিয়ে অরিত্রির অপারেশন থিয়েটারে গিয়েছিলেন?”
কথা গুলো বলে একটা রিপোর্ট সামনে এগিয়ে দিলো নিহান। ড.সেন নিহানের কথা শুনে শুকনো ঢুক গিলে নিলো। যেনো চোরের চুরি করে ধরা পড়েছে।

“আমি কিছু জানিনা। আমি যখন অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে ওয়াশরুমে যাই এবং বের হয়ে এসে টেবিলের কাছে যায় তখন এ গুলো আমার টেবিলের উপর পেয়েছিলাম। আমার তাড়াহুড়ো থাকায় টেবিলের উপর থেকে স গুলো আমি সাথে করে নিয়ে যায় অপারেশন রুমে।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই পাশে থাকা রড দিয়ে পায়ে সজোরে একটা বারি দিলো ড.সেনকে। পায়ের আঘাত পাওয়ার সাথে সাথেই ড.সেন চিৎকার করে উঠলো।

“তোর যেই বাপকে বাঁচাতে মিথ্যা কথা বলছিস তোর সেই বাপকে আমি খুঁজে বের করবোই এবং তোকে আর তোর বাপকে আমি নিজ হাতে শেষ করবো। খুব শখ ছিল তাই আমার পিছনে লাগার। এইবার তোদের প্রত্যেককে আমি আমার আগের রূপ দেখিয়ে দিবো। কি ভেবেছিলি তোরা আমার থেকে অরিত্রিকে আলাদা করে দিয়ে নিজেদের রাজত্ব করবি? এই নিহান সেটা কি ভাবে হতে দিবে বলতো? আমার সাথে বেইমানি, আমার অরিত্রিকে আমার থেকে আলাদা করার শাস্তি আমি প্রত্যেককে দিবো। আর তোর বাপকে বলিস যেনো আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।”
কথাটা বলে লোকটাকে আবারো একটা বারি দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো নিহান। আর ড.সেন আবারো অচেতন হয়ে পড়ে রইলো একই ভাবে। এই দিকে নিহান বের হয়ে যাওয়ার আগে দরজার আড়াল থেকে কেউ একজন বের হয়ে চলে গেলো।

“এতো রাতে কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?”
নিহান রুমে প্রবেশ করতেই প্রশ্ন করলাম। আমার কন্ঠ শুনে যেনো কিছুটা অবাক হলো। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলো না। তাই আবারো প্রশ্ন করলাম।
” কিচেনে গিয়েছিলাম। ঠান্ডা পানির জন্য। তুমি হয়তো রুমে পানি রাখতে ভুলে গিয়েছিলে।”
কথাটা বলেই হাতে থাকা জগ উঁচু করে দেখিয়ে আমার সাইটে থাকা টি টেবিলে রাখলেন তিনি।
” আমাকে ডেকে দিতেন আমি নিয়ে আসতাম ‌ আর কথাটা বললেই হতো। আমি আপনাকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”

“ভয় পাওয়ার কিছু হয়নি। আমি আছি তো তোমার সাথে সবসময়।”
কথাটা বলেই কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলেন তিনি। কপালে ছোঁয়া পেতেই আবেগি হয়ে গেলাম।
“আপনি এভাবে কোথাও যাবেন না আমাকে ছেড়ে। আমার ভয় করে ভীষণ। আপনাকে এখানে না দেখে আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছি হয়তো সে-ই চিরকুট,,,”
কথাটা আর শেষ করলাম না। নিহানের পেটের অংশ জড়িয়ে ধরে নিরবে চোখের পানি ঝড়িয়ে গেলাম। যখন ভদ্রলোককে আমার পাশে না দেখলাম তখন বুকটা ধক করে উঠলো। আর মস্তিষ্কে আবারো সেই পুরনো কথাটা মনে পড়ে গেলো।

” কিছু হয়নি আমি এখানেই আছি। তুমি ঘুম আসো। আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ”
কথা গুলো বলে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আমিও ছোট বাচ্চাদের মত জড়সড় হয়ে নিহানকে আঁকড়ে ধরে চোখ বুঝলাম।

অবেলায় এলে তুমি পর্ব ১০

“নিহান তুমি অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছো। এবার যে তোমাকে থামতে হবে। এতো দিন তুমি খেলে গিয়েছো এবার আমি খেলবো।”

অবেলায় এলে তুমি পর্ব ১২