অবেলায় এলে তুমি পর্ব ১
তামান্না ইসলাম কথা
বাসর ঘরে যখন আমি আমার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন আমার স্বামীর পরিবর্তে আমার শাশুড়ি আসলেন আর সাথে করে চার পাঁচ মাসের মতো একটা টুকটুকে বাচ্চা মেয়ে নিয়ে আসলেন। শাশুড়ি আর ছোট বাচ্চা মেয়ে দেখে প্রথমে অবাক না হলেও পরে যখন আমার শাশুড়ি বললেন, সে আমার সাথে ঘুম আসবে এবং তার কোলের বাচ্চা আমার স্বামীর প্রথম স্ত্রীর সন্তান তখন যেনো আমি আকাশ থেকে পড়লাম।
স্বামীর পরিবর্তে শাশুড়ি থাকবে? কথাটা খারাপ শুনা লাগলেও যে কারো মনে এই প্রশ্নই আসবে। আর তার থেকে বড় কথা আমি আমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী? তার একজন মেয়েও আছে? আমি দ্বিতীয় স্ত্রী হলে তার প্রথম স্ত্রী কোথায়? আমার সাথে এতো বড় ধোঁকা হয়ে গেলো। সবাই মিলে যে আমার থেকে এতো বড় বিশ্বাস ঘাতকতা করবে বুঝতে পারিনি। আমার নিজের মামা মামী আমার সাথে এমন করতে পারলো? আমি কি মামা মামীর সংসারে বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম?
আরও পর্ব গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
আমি তো নিজের খরচ, বাড়ির সকল কাজ আমি করেই দিচ্ছিলাম তাহলে আমার সাথে এতো বড় প্রতারণা করলো? এর জন্য বুঝি মামী আমাকে কারো সাথে কথা বলতে দেয়নি! কিন্তু মামা! মামা তো আমাকে একটা বারের জন্য সত্যি কথা জানাতে পারতো। নিজের সব কিছু একপাশে রেখে মামাকে শ্রদ্ধা করি বলেই তার কথা মতো বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। কিন্তু সেই বিয়েই যে সম্পূর্ণ মিথ্যে দিয়ে ঘেরা। আমি কি করবো এখন কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রতিটা মেয়ের নিজের বিয়ে নিয়ে, স্বামী, শশুড় বাড়ি নিয়ে কত স্বপ্ন থাকে। তেমন আমারও অনেক স্বপ্ন ছিল কিন্তু সেই সব কিছু যে এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে আমি কখনো বুঝতে পারিনি। আমি এখন কাকে কি বলবো? নিজের মা বাবা না থাকলে, অন্যের সংসারে থাকলে বুঝি সবাই এমন করে?
“কি হলো মা? এমন করে তাকিয়ে আছো কেন?”
“না কিছু না। কিন্তু এই বাচ্চা?”
“ওমা! তুমি জানো না এইটা তো নিহানের মেয়ে নিরাত্রি।”
শাশুড়ির কোলের বাচ্চাকে দেখে প্রশ্ন করতেই কথাটা বললেন তিনি। তিনি যতটা সহজ ভাবে কথাটা বললেন আমি ঠিক তার থেকে বেশি অবাক হয়েছি।সবাই সব কিছু জেনে আমাকে একজন বিবাহিত পুরুষ এমনকি এক মেয়ে বাবার সাথে বিয়ে দিলো?
“কোনো সমস্যা?”
শাশুড়ির কথা শুনে কোনো রকম মাথা নেড়ে কিছু না বলে মাথা নিচু করে নিলাম। যেখানে আমার সাথে এতো বড় প্রতারণা করা হলো সেখানে আমি আর কি বলবো? কিন্তু আমি আর আমার স্বামী কোথায় বা তার প্রথম স্ত্রী কোথায় আর আজকে শাশুড়ি কেন থাকবে তাও জিজ্ঞেস করলাম না এক চাপা অভিমান, কষ্টের জন্য।
” নিহানের হঠাৎ একটা জরুরী কল আসায় সেই সন্ধ্যায় অফিসের কাজে শহরের বাইরে চলে গেছে। আমি কল করেছিলাম কিন্তু আজকে আসতে পারবে না তাই আমি ভাবলাম আজকে তো তোমার প্রথম দিন এই বাড়িতে তাই আমি আজকের রাতটা তোমার সাথে থাকি।”
আমার নিরবতা হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাইতো কথা গুলো বললেন। আমি এবারো কিছু না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলাম। আমার শাশুড়ি যে সহজ সরল একজন মানুষ যেই দিন আমাকে প্রথম দেখতে এসেছিল সেই দিন তার কথা শুনে বুঝতে পেরেছিলাম। আমার শশুড় নেই। সে না কি আমার স্বামীর যখন দশ বছর বয়স তখন মারা গিয়েছেন। তারপর থেকেই আমার শাশুড়ি একা একা ছেলেকে মানুষ করেছেন, লেখাপড়া শিখিয়েছেন। শশুড়ের বাড়ি, গাড়ি থাকায় কিছুর অভাব ছিলো না। তবুও একা একজন মেয়ে মানুষের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠে সমাজে একা একা চলাফেরা করতে।
কথাটা বলেই আবারো কিছু সময় চুপ করে বসে থাকলাম। ভিতর থেকে কান্না গুলো যেনো বের হয়ে আসছে। কোনো রকম উপরে উপরে নিজেকে ঠিক রাখলাম। এইদিকে ভারি শাড়িতেও যেনো অস্তির লাগছে। সব কিছু কেমন জানি ঘোর ঘোর লাগছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো আমার সাথে।
“আপনি বসুন আমি শাড়ি পাল্টে আসছি।”
কথাটা বলে বিছানা থেকে নেমে ব্যাগ থেকে অন্য একটা শাড়ি নিয়ে ধীরে ধীরে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলাম। ওয়াশরুমে এসেই ট্যাপ ছেড়ে কান্না শুরু করে দিলাম। এতো সময় ধরে যেই কান্না গুলো গলায় আটকে রেখেছিলাম এবার তা বের হয়ে আসতে লাগলো। আমি কখনো কারো প্রথম মানুষ হতে পারলাম না। আমার সাথেই এমন হতে হলো? আমি নিজের উপর আর নিজের ভাগ্যের উপর, সৃষ্টিকর্তার উপর অভিযোগ করতে লাগলাম। মামা আর মামীর উপর ভীষণ রাগ হলো কেন তারা আমার থেকে সত্যিটা লুকিয়ে গেলো তার জন্য। আর মনে মনে ঠিক করলাম আমি এখানে থাকবো না। চলে যাব দূরে কোথাও। তার আগে মামা মামীর মুখোমুখি হতে হবে আমাকে। আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তাদের। কেন করলো তারা আমার সাথে এমন? একটু পর রুমের ভিতর থেকে শুনতে পেলাম বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসছে। তাড়াতাড়ি করে চোখে পানি দিয়ে শাড়ি চেঞ্জ করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসলাম। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখি শাশুড়ি আম্মা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।
” আমার কাছে বাবুকে দিন আমি সামলচ্ছি। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”
শাশুড়ির থেকে বাচ্চাকে আমার কোলে নিতে নিতে কথা গুলো বললাম। মেয়েটা আমার কোলে আসতে না আসতেই কান্না থামিয়ে দিলো। আর নিজের ছোট ছোট হাত পা নাড়াতে লাগলো। কি নরম তুলতুলে শরীরটা। একদম ননীন পুতুলের মতো। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। কি মিষ্টি মেয়েটা আর আমার মতো তারও ডান ব্রুয়ের মাঝে কুচকুচে কালো তিল আছে। টপ করে গালে চুমু দিয়ে দিলাম। একবার শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছেন।
” এখন থেকে নিরাত্রি, এই সংস্যার আর আমার বদমেজাজি ছেলের দায়িত্ব তোমার। আমার এতো বছরের সাজানো সংসারটা দেখে রাখার দায়িত্ব আজ থেকে তোমার মা। আমার দিদিভাইকে আর আমার ছেলেটাকে তুমি দেখে রেখো মা।”
শাশুড়ি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কথা গুলো বললেন। আমিও আর কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়িয়ে নিরাত্রিকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। আর শাশুড়ি এক পাশে শুয়ে পড়লেন।
রাত একটা বেজে পনেরো মিনিট। শুনশান নির্জন রাতে কবরের পাশে বসে আছে এক যুবক। পরনে একটা সাদা রঙের পাঞ্জাবি। কবরের পাশে বসে বসে চোখের অশ্রু ফেলে চলেছে আর কিছু বলছে যেনো। তার থেকে কয়েক হাত দূরে একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে চলেছে। এমন নিরব পরিবেশে একটা মানুষ কবরের পাশে বসে আছে। এই গভীর রাতে কেউ নেই আর থাকার কথাও না। রাতের বেলা কবরের কথা শুনলেই কিছু মানুষের গলার স্বর চেঞ্জ হয়ে যায়। সেখানে একজন লোক এতো রাতে কবরের পাশে বসে বসে কান্না করছে। বড্ড অদ্ভুত বিষয়টা। এতো রাতে কারই বা কবরের পাশে বসে সে? এতো রাতে কেউ কবরে আসে কি? যে কোনো সাধারণ মানুষ শুনলেই প্রশ্ন গুলো করবে। কিন্তু না সত্যি কেউ একজন এই গহীন রাতে কবরের পাশে বসে কান্না করছে।
“অরিত্রি! কেমন আছো আমাকে আর আমাদের প্রিন্সেসকে ছেড়ে? তুমি নিশ্চয় ভালো আছো তাই না? কিন্তু আমি তো ভালো নেই তোমাকে ছাড়া। আমাদের কথা হয়েছিল আমরা সবসময় একসাথে থাকবো তাহলে তুমি কেন আগে চলে গেলে? একটা বার আমার কথা মনে হলো না তোমার? কেন সেই দিন তুমি আমাকে একটি বারের জন্য ফোন করলে না?
সেই দিন যদি আমি তোমার সাথে থাকতাম তাহলে হয়তো আজ তুমি আমার সাথে থাকতে। জানো তো আমাদের ছোট্ট মেয়েটা একদম তোমার মতো হয়েছে। তোমার মতো ঠিক ব্রু এর মাঝে একটা তিল আছে। আর চোখ দুটো অবিকল তোমার মতো হয়েছে। মায়া-মায়া চেহারা। কিন্তু তুমি তো নেই। আমার ঘর অন্ধকার করে দিয়ে চলে গেলে আমার থেকে। তুমি বড্ড নিষ্ঠুর অরি।”
কবরের পাশে বসা থেকে সেখানে মাথার নিচে দুই হাত রেখে আকাশে দিকে তাকিয়ে শুয়ে পড়লো ঘাসের উপর। আকাশে সব থেকে বেশি আলো দেওয়া তারার দিকে তাকিয়ে রইল কিছু সময়।
চারিদিকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। আজানের সুর যেনো পৃথিবীর সব সুরের থেকে সুন্দর। এখনো পাখির কলকাকলি শুরু হয়নি। আজানের ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে চারপাশ। আজানের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। ঘুম থেকে উঠে বসে বসে আজানের জবাব দিয়ে উঠে যেতে লাগলাম বিছানা থেকে। কিন্তু বিছানা থেকে নামতেই শাড়ির আঁচলে টান অনুভব হতেই পিছনে ফিরে দেখি নিরাত্রির হাতের মুঠোয় শাড়ির আঁচল। এইটুকু মেয়ের কাজে কেমন যেনো এক ভালো লাগা কাজ করতে লাগলো। একদিনেই কেমন মায়ায় বেঁধে ফেলেছে। আমি বরাবরই বাচ্চাদের প্রতি দুর্বল। বাচ্চাদের ছোট ছোট হাত,পা ভালো লাগে। বিশেষ করে যখন হাত পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে খেলতে শুরু করে এবং ঠোঁটে এক মিষ্টি হাসি থাকে তখন যেনো আস্ত এক মায়ার চাদরে ঘেরা পুতুল মনে হয়। কিছুটা ঝুঁকে নিরাত্রির হাতের মুঠো থেকে শাড়ির আঁচ ছাড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলাম ওজু করতে।
নামাজ আদায় করে উঠে দেখি শাশুড়ি সেও উঠে বসে আছে। হয়তো নামাজ পড়বে। শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মেয়ের পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। এখনো শান্ত ভাবে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমি মেয়েটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। নিরাত্রি কার মতো দেখতে হয়েছে? বাবার মতো? না কি মায়ের মতো? মায়ের কথা মনে হতেই আবারো সব কিছু মনে পড়ে গেলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের পাশেই আধশোয়া হয়ে বসে আঁখিজোড়া বন্ধ করে নিলাম। সব কিছু কেমন জানি বিষের মতো লাগছে। কত স্বপ্ন ছিলো কত আশা ছিলো সব কিছু কেমন জানি মূহুর্তের মাঝেই শেষ হতে বসে পড়লো।
“দেখে হাঁটতে পারেন না? অন্ধ না-কি?”
নিরাত্রিকে ঘুম পাড়িয়ে ছাদে একটু হাঁটছিলাম। নানান রকমের ফুল গাছ দিয়ে ঘেরা। কিছু নাম না জানা ফুলও আছে সেখানে। আনমনা হয়ে ফুল গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিলাম। কিন্তু কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে বসলাম। আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের দিকে তাকাতেই বিরক্তসহীত উক্ত কথা গুলো বললো। এমনিতেই মন খারাপ তার উপর এই গরমে লোকটার কথাতে মেজাজ বিগড়ে গেলো।
“আমি না হয় চোখে দেখি না তা আপনি কি দেখে চলতে পারলেন না? যেই সামনে সুন্দরী মেয়ে দেখলেন আর ওমনি ধাক্কা দিতে হলো? বুঝি না আপনাদের আমি? বাসায় মা বোন নাই? চোখ দুটো কি পকেটে নিয়ে ঘুরে ফিরেন? যতসব আজাইরা পাবলিক। সরুন সামনে থেকে।”
লোকটাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে চলে এলাম। রাগে এতোটাই বষিভোত হয়ে ছিলাম যে লোকটা এখানে কি ভাবে এসেছে তাও খেয়াল করলাম না।
“কি হয়েছে? এতো রেগে আছো কেন?আর নিহান কোথায়?”
শাশুড়ির কথা শুনে কিছুটা রাগের মাত্রা বেড়ে গেলো। সে নিজেই তো বলেছিলো তার ছেলে শহরের বাইরে গেছে তাহলে আমি কি করে বলবো তার ছেলে কোথায়?
“আমি কি জানি আপনার ছেলে কোথায়? সেই গতকাল সন্ধ্যায় বের হয়েছে এখন বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে আপনার ছেলের নাম গন্ধ নাই। শুনেন আম্মা আপনার ছেলে আজকে বাসায় আসলে ইচ্ছে মতো কানমোলা দিয়ে দিবেন আর বকুনি দিবেন, আর…”
“আর কি? আর কে আমাকে বকুনি দিবে?”
আর কে আমাকে কানমোলা দিবে?”
নিজের কথা শেষ করার আগেই পিছন থেকে কেউ কথা গুলো বললো। আর তার কন্ঠ শুনে পিছনে ফিরতেই মানুষটাকে দেখেই চুপ করে গেলাম।